গ্রামবাংলা ও আমার ছেলেবেলা (দুই)

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

গ্রামবাংলার প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলছিলাম। গ্রামের আলামতারা হুজুররা (সুরা ফিল পর্যন্ত যাদের মুখস্থ ক্ষমতা ছিল) বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে তাবিজ প্রদান করতেন। ছোট মসজিদের এসব ঈমাম সাহেবগণ অনেক সময় বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাহিদানুযায়ী ঝাড়ফুক ও তাবিজ দিতেন। দু’চার আনা যা-ই হাদিয়া হিসেবে দেয়া হত তা খুশিমনে গ্রহণ করতেন। কারো কারো একটা বিশেষ পদ্ধতি ছিল সোয়াপাঁচ আনা বা এক টাকা এক আনা দিতে হবে। যা পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেড্ডার মমতাজ উদ্দিন তার স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের হাদিয়ার পরিমাণ একশ’এক টাকাতে উন্নিত করেছিলেন। যে কোন ব্যবসা যেমন জীবনে একবার ক্লিক বা হিট করলেই বড়লোক হওয়া যায় মমতাজ উদ্দিনের ব্যাপারটাও হয়ত তেমনই ছিল। বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে হকার বা ক্যানভাসাররা মমতাজ উদ্দিনের তাবিজের অলৌকিক ক্ষমতা ব্যাখ্যা করে একটা লম্বা বক্তৃতা দিতেন, অতঃপর অনেকের নিকট থেকে সফলতার সাক্ষ্য গ্রহণ করে তাবিজ বিক্রি করতেন। কিশোর বয়সে তাদের এসব মধুর ক্যানভাস তন্ময় হয়ে অনেক শুনেছি।
মাঝে মাঝে দাদি আমার মক্তব-হুজুরের কাছ থেকে বিভিন্ন কারণে তাবিজ আনতে পাঠাতেন। নিয়ম ছিল হুজুরের নিকট থেকে তাবিজ নেয়ার পর এক দৌড়ে বাড়ি আসতে হবে এবং পিছন ফিরে তাকানো যাবে না। পিছন দিকে তাকালে তাবিজ হাতের মুঠো হতে উধাও হয়ে যেতে পারে। মনে আছে দুরু-দুরু বুকে এক দৌড়ে কারো সাথে কথা না বলে মুষ্টিবদ্ধ তাবিজ নিয়ে হাফাতে হাফাতে বাড়ি ফিরতাম।
টীকাদান কর্মসূচি ফলপ্রসূ হওয়ার কারণে গ্রামগঞ্জে আজ নিওনেটাল টিটানাস বা শিশু ধনুস্ট্রংকার নেই বললেই চলে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নবজাতকের ধনুস্ট্রংকার হলে বলা হত শিশুকে রাতে ঠিকমত পাহারা না দেয়ার করণে ডাইনী বা পেতœী তার বাচ্চাকে বদলে মানুষের বাচ্চাকে নিয়ে গেছে। ধনুস্ট্রংকারের কনভালশন বা খিচুনির কারণে শিশু লালনীল বর্ণ ধারণ করলে মনে করা হত এটা পেতœীর বাচ্চার প্রকৃতরূপ। প্রতিটি নবজাতককেই টুটকা হিসেবে পুরোনো জাল বা ঝাকিজাল দিয়ে ঢেকে রাখা হত যাতে পেতœীরা জালের ভিতরে প্রবেশ করত না পারে। আমি চাকুরী জীবনের প্রথমাংশে বহু প্রসুতির ঘরে এসব জালের ভিতর হাঁটু গেড়ে বসে মা ও শিশুর চিকিৎসা করেছি। নিঃসন্দেহে আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি, মানুষের সচেতনতা এবং শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফলে তা অনেকটাই কমে এসেছে।
ভাটি বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বর্ষার পানি কমে যাওয়ার সময় বিশেষ করে কার্তিক মাসে প্রায় প্রতিটি গ্রামেই কলেরা শুরু হত। প্রতি বছর গ্রাম হতে চল্লিশ পঞ্চাশ জন বিয়োগ হতেন।
ঐ সময়ে ফিফটি ফিফটি হিন্দু মুসলিম অধ্যুষিত আমার গ্রামের একদল কবরস্থানে এবং আরেকদল সারাক্ষণ শ্মশানে থাকতেন মরদেহ সৎকারের উদ্দেশ্যে। তখন টিউবওয়েল ছিল না, পুকুর বা নদীর পানিই ছিল পানীয় জল।
আমার বয়স যখন ছয়-সাত তখন প্রায় সত্তোরোর্ধ আমার দাদা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে একদিনের ভিতরেই ইন্তেকাল করেন। উনার হাতপায়ে তেল মালিশ ও মাথায় পানি ঢালা ছাড়া আর কোন চিকৎসার কথা আমার মনে পড়ে না। ওরস্যালাইন তখনো আবিষ্কার হয়নি, রগের স্যালাইনের কোন স্মৃতি মানসপটে ভাসছে না।
দাদার মৃত্যুর চার-পাঁচদিন পর আমিও কলেরায় আক্রান্ত হই। একান্নবর্তী পরিবারে আমিই একমাত্র সাত বছেরের কনিষ্ঠতম সদস্য। প্রায় অবধারিত মৃত্যুর কথা ভেবে শুনেছি ঘরের সবাই তখন আহাজারি শুরু করেছিলেন। পাড়া পড়শী সহ গ্রামের সবাই তখন বাড়িতে ভিড় জমিয়েছিলেন, যদিও ঐ সময়ে উপরিরোগ ভেবে কলেরা আক্রান্ত বাড়ি অনেকেই এড়িয়ে চলতেন। আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সকল শিক্ষকগণও নাকি আমাকে দেখতে এসেছিলেন। অবশ্য এর অনেকগুলো কারণও ছিল। সামাজিক প্রেক্ষপটে আমার দাদার পুরোগ্রামে অন্যরকম এক গ্রহণযোগ্যতা ছিল। বাবা-চাচা চারজনের বিশেষ ভূমিকায় পরিবারের অর্থনীতির চাকার ধনাত্মক ঘূর্ণন ছিল তখন চোখে পড়ার মত। অবশ্য ছোটচাচা পুরো গুষ্টির মাঝে অতীত ইতিহাস ভঙ্গ করে একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলো দূরে নামকরা এক উচ্চ বিদ্যালয়ে তখন পড়তেন। আমাকে আট-ন’মাস আগে ভর্তি করানো হল গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। সারা গ্রামে শিক্ষার হার শতকরা বড়জোর পাঁচ থেকে দশ। আমার ছোট চাচাকে স্কুলে ভর্তি করানোর পেছনেও এক কাহিনী ছিল। বাড়ির আশেপাশে তেমন কোন শিক্ষিত ব্যক্তি না থাকায় দাদা একদিন একখানা চিঠি পড়ে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য গ্রামের পূর্ব মাথায় অর্ধশিক্ষিত এক ভদ্রলোকের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। উনি কিছুটা গড়িমসি করায় দাদা বাড়ি ফিরেই চাচাকে মাঠ থেকে ধরে নিয়ে তৎক্ষণাৎ স্কুলে ভর্তি করান।
অতএব দাদার আদূরে নাতি বা বাবা-চাচাদের একমাত্র স্নেহের ধন আমাকেও স্কুলে পড়তে হবে বৈ কি। তাই বাবা কয়েক মাস পূর্বে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য অনাগ্রহী আমাকে অনেক্ষণ মাঠে দৌড়িয়ে ধরেছিলেন। কাপড়-চোপড় পড়েও ঘরের তরজা বা পার্টিশনের ঝুলানো চাটাইয়ের পিছনে লুকিয়ে ছিলাম। নিচ দিয়ে যে পা দেখা যাচ্ছে তা বুঝে আসেনি, ঠিক চোখ বুঝে পালকের নিচে কাকের মরিচ লুকানোর গল্পের মতই। বাবা টেনে-হেঁচড়ে স্কুলের শিক্ষক দীনেশ চন্দ্র স্যারের হাতে সমজিয়ে দিয়ে আসলেন। একমাত্র বই ‘ছড়া ও পড়া’। স্যার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করলেন, অনেক মজার মজার গল্প শুনালেন। স্কুল ও পড়ার প্রতি কেমন যেন একটা আসক্তি জমে গেল। মাত্র তিন মাসেই বই শেষ করা, তখনকার সময়ে প্রচলিত মানসাঙ্কে পারদর্শিতার কারণে সকল শিক্ষকগণ ভাল ছাত্র মনে করে অনেক স্নেহ করতে লাগলেন। সে সুবাদে স্বল্পশিক্ষিত গ্রামের সকল মুরুব্বি ও বাবার বন্ধুগণের নিকট অল্প দিনেই ভাল ছাত্র হিসেবে একটা পরিচিতি পেয়ে গেলাম। তাই হয়ত পাড়া পড়শী, আত্মীয়-স্বজন ও আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলী এ বিরাট অসুখের মুহূর্তে বাড়িতে অন্যরকম এক মায়ার টানে ভিড় জমিয়ে ছিলেন।