এসএম সুরুজ আলী ॥ মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে ১১ দিন পর কবর থেকে স্কুলছাত্রী জেরিনের লাশ উত্তোলন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করা হয়। এর আগে রবিবার অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শাহীনুর আক্তারের আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলীর আবেদনের প্রেক্ষিতে লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের আদেশ দেয়া হয়। এ প্রেক্ষিতে সদর থানা পুলিশ গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ধল টং টং শাহ’র মাজারস্থ কবর স্থান থেকে লাশ উত্তোলন করে। এলাকার লোকজন লাশ দেখতে কবর স্থানের আশপাশে ভীড় জমান। লাশ উত্তোলন শেষে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি মাসুক আলী। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী শেষে জেরিনের লাশ হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়। ময়না তদন্ত শেষে সন্ধ্যায় পুনরায় লাশ দাফন করা হয়। লাশ উত্তোলনকালে উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোঃ রবিউল ইসলাম, সহকারী কমিশনার শাহ আজিজ, সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মাসুক আলী, ইন্সপেক্টর দৌস মোহাম্মদ, এসআই সাহিদ মিয়া।
এ ব্যাপারে জেরিন হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মাসুক আলী জানান, জেরিন দুর্ঘটনায় মারা গেছে মনে করে মরদেহ বিনা ময়না তদন্তে দাফন করে তার পরিবার। পরে পুলিশি তদন্তে বেড়িয়ে আসে ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা নয়। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় মেয়েটিকে অপহরণের চেষ্টা চালায় জাকির হোসেন ও তার দুই সহযোগী। অপহরণকারীদের কাছ থেকে বাঁচতে গিয়ে সিএনজি অটোরিক্সা থেকে পড়ে মেয়েটির মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, হত্যা মামলা দায়ের করায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পুনরায় দাফন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সুরতহাল রিপোর্টে জেরিনের মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে ১১ দিন হলেও জেরিনে লাশ ছিল অক্ষত। লাশের মধ্যে পচন ধরেনি বা দুগ্ধ ছড়ায়নি।
এদিকে জেরিনের লাশ উত্তোলনের খবর পেয়ে আগ থেকেই এলাকার লোকজন কবরস্থানের আশপাশে এসে ভীড় করতে থাকে। একপর্যায়ে তা সহ¯্রাধিক হয়। এসময় জেরিন হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে তারা বলেন, আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল মেয়েটির। ঘটনার সাথে জড়িতদের ফাঁসি না হলে জেরিনের আত্মা শান্তি পাবে না। এদিকে জেরিনের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হবে জানতে পেরে তার পরিবারের লোকজন রীতিমত অসুস্থ হয়ে পড়েন। জেরিনের পিতা আব্দুল হাই বলেন, লাশ উত্তোলন হবে জানতে পেরে মেয়ের মা অসুস্থ হলে তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের সবার প্রেশার বেড়ে গেছে। আর বাঁচতে পারব কিনা বলতে পারি না। যদি লাশ উত্তোলনের দৃশ্য আমার চোখে পড়ত তাহলে হয়তো স্ট্রোক করেই আমি মারা যেতাম।
হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ও ময়নাতদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাঃ দেবাশীষ দাস জানান, ময়নাতদন্ত করার পর পুনরায় লাশ কবরে রাখা হয়েছে। তবে এখনই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে না।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর সার্কেল) মোঃ রবিউল ইসলাম জানান, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে স্কুলছাত্রী মদিনাতুল কোবরা জেরিনকে রাস্তা থেকে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে অপহরণ করে নিয়ে যায় একই গ্রামের জাকির হোসেন। গাড়িতে জেরিন চিৎকার ও ধস্তাধস্তি করলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় জাকির ও তার সহযোগীরা। পুলিশ হত্যার রহস্য উদঘাটন করে এবং জাকিরকে গ্রেফতার করে। জাকির আদালতে স্বীকার করে জেরিন তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ক্ষুব্ধ হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ জানুয়ারি সকাল ৯টায় জেরিন স্কুলে কোচিংয়ে যাওয়ার পথে তার বন্ধু সিএনজি চালক নুর আলম ও হৃদয়কে নিয়ে জেরিনকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে জাকির। অপহরণে ব্যর্থ হয়ে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গুরুতর আহত হয় জেরিন। আহত অবস্থায় তাকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্মরত চিকিৎসক তাকে সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওসমানি মেডিকেলে সে মারা যায়। প্রথমে এ ঘটনাটি দুর্ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়। পরে পুলিশ তদন্ত করে এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে।
প্রসঙ্গত, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের আব্দুল হাই’র মেয়ে এবং রিচি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী জেরিন গত ১৮ জানুয়ারি সকাল ৮টায় নূর আলমের অটোরিক্সায় করে বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল। আগে থেকেই গাড়িতে ছিল হৃদয় নামে এক যুবক। পথিমধ্যে অটোরিক্সাতে তুলে নেয়া হয় জাকিরকে। সিএনজি অটোরিক্সাটি জেরিনের স্কুল পেরিয়ে গেলেও তাকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছিল না। এ সময় নামার চেষ্টা করলে জেরিনের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু হয় অপহরণকারীদের। এক পর্যায়ে সে অটোরিক্সা থেকে লাফ দিলে পড়ে গেলে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ জানুয়ারী সকালে মারা যায় জেরিন। ঘটনার পর নিহত ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানায় ৩ জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ প্রেক্ষিতে মামলার প্রধান আসামী জাকির হোসেনকে (২০) গ্রেফতার করে পুলিশ। সে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের দিদার হোসেনের ছেলে। ওইদিনই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেয় জাকির। বাকী দুই আসামী একই উপজেলার পাটুলী গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে অটোরিক্সা চালক নূর আলম (২০) ও জাকিরের সহযোগী পাটুলী গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে হৃদয় মিয়া (২০)। তারা বর্তমানে পলাতক রয়েছে।