সমাজ দর্পন

তাহমিনা বেগম গিনি
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যরে গর্বিত শহর হবিগঞ্জ। রাজনৈতিক বিরোধে যখন দেশের কোথাও আগুন জ¦লে তখন হবিগঞ্জবাসী নিস্তরঙ্গ রাত দিন যাপন করেন। ধর্মীয় কারনে বাংলাদেশে মিছিল মিটিং হয় কিন্তু হবিগঞ্জবাসীর অসাম্প্রদায়িক বন্ধন অনেক দৃঢ়। আমি সবসময় বলি হবিগঞ্জ শান্তির শহর। কিন্ত শহরটি কি বদলে যাচ্ছে ? বাংলাদেশে ধর্ষন এখন মহামারী। প্রতিদিন বৃদ্ধা, শিশু, শিক্ষার্থী, শ্রমিক, কর্মজীবি মহিলা, গৃহিনী, প্রতিবন্ধি, ভিক্ষুক ঘরে, শিক্ষালয়ে, কোচিং সেন্টারে, অফিসে, কলেজে, বাসে, লঞ্চে, গাড়ীতে, পর্যটন কেন্দ্রে, চলমান রাস্তায় ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। হবিগঞ্জও একেবারে পিছিয়ে নেই। বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা বিভিন্ন উপজেলা ও জেলায় ঘটেছে। বানিয়াচং এ শিক্ষক কর্তৃক শিশু শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। শক্তিশালী পুলিশ প্রশাসন ধর্ষণের ঘটনা সুরাহা করেছেন কঠোর ভাবে, হত্যাকারী এবং আসামীকেও পত্রিকার মাধ্যমে জনসম্মুখে এনেছেন। কিন্ত তারপর….. বলতে হয় ‘তার আর পর নেই’। আজ পর্যন্ত শুনিনি এ অপরাধের জন্য কারো ফাঁসি কার্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্যকরী হয়েছে। দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই ধর্ষণকামিতা বাড়িয়ে তুলেছে। পর্যটনের শহর হবিগঞ্জ। বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ভরপুর সিলেট বিভাগ, তার মাঝে হবিগঞ্জ অন্যতম। মাত্র ২৮ দিনের ব্যবধানে দুটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। প্রকৃতিক অপার দান এই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। গভীর বিশাল বনরাজি। প্রেমিক-প্রেমিকারা, অথবা পর্যটকেরা বনের কতটুক সীমানা পর্যন্ত যেতে পারবেন তার কি কোনো আইন নেই ? এত বড় উদ্যানের ভিতর কোনো পুলিশ ফাঁড়ি নেই এবং পর্যটন পুলিশের অপ্রতুলতা সর্বদা চোখে পড়ে। মাত্র দুটি গণধর্ষণের ঘটনা জনসম্মুখে এসেছে। অহরহই এমন ঘটনা ঘটে চলেছে, অনেকেই এসব জানেন। সেদিন এক জাতীয় পত্রিকায় লিখেছে ‘সাতছড়ি উদ্যানে পর্যটকের সংখ্যা কমে গিয়েছে।’ আমরা কি এতই দূর্বল যে একটি জাতীয় উদ্যানের পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনা ? সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টি গোচর করছি। বেশ কয়েক বছর ধরে মাইকে ঘোষনা শুনি না ছেলে হারিয়ে গিয়েছে অথবা মেয়ে সন্তান হারিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করে কয়েকদিন আগে শুনে অজানা আতঙ্কে মনটা অর্তনাদ করেছিল। কারণ আজকাল বৃদ্ধ, যুবা, কিশোর, শিশু যেই হারিয়ে যান অথবা অপহৃত হন হয় কিছুদিন পর তার ছিন্ন ভিন্ন গলিত লাশ অথবা কংকাল পাওয়া যায়। সৌভাগ্যক্রমে যারা পরিজনের কাছে ফেরত আসেন তারা মুখে কথা বলেন না। তাই ছেলেটিকে নিয়ে অজানা আশংকায় ছিলাম। গত ১৬ জানুয়ারির স্থানীয় পত্রিকায় যখন সেই ছেলেটির হাত পা বাঁধা লাশের ছবি সাথে ঘটনা প্রবাহ পড়লাম তখন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা মনের পাতায় ভেসে উঠলো। সবচেয়ে অবাক হয়েছি জে, কে, এন্ড এইচকে হাই স্কুলের এক ছাত্র জড়িত। ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে পত্রিকায় লেখা আছে দেখে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিশোর অনেক অপরাধির লোমহর্ষক ঘটনা পড়ি, শুনি। হয়তো বা ছেলেটি অপরাধী নাও হতে পারে। তারপরও ভাবনা পেয়ে যায় ‘হবিগঞ্জে কেন?’ আসলে সমাজটা কেমন বদলে গিয়েছে। পিতা-মাতার চিরন্তন রুপও কি বদলে যায় ? না হলে একটি পরিবারের কিশোরী, যুবতী মেয়ে প্রেমিকের সাথে কিভাবে অসময়ে যেখানে সেখানে বেড়াতে যায় ? শিশু পুত্রের হাতে মা কিভাবে দামি মোবাইল তুলে দেন ? একটি গল্প দিয়ে লেখা শেষ করছি- আমি তখন স্কুলে পড়ি। ছোট বেলা থেকে এই বৃদ্ধবেলা পর্যন্ত কখনোই বিলাসব্যসনে জীবন যাপন করিনি। ফুল আর বই আমার সবচেয়ে প্রিয় সাথে সমুদ্র। আমাদের বাসায় তখন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক নাজিবুর রহমান সাহেব একবার এসেছিলেন। আমার মার সাজানো সাধারণ ড্রয়িং রুমে বসে বলেছিলেন ‘সারাজীবন মনে রাখবে একটি পরিবার কতখানি আধুনিক বোঝা যায় তাদের বসার ঘরের এককোনে বই এর ছোট একটি আলমারী থাকে যদি। সোফা কত দামি তা দিয়ে অর্থের প্রাচুর্য নিরূপন করা যায় কিন্তু আত্মিক প্রাচুর্য নয়।’ মাঝে মাঝে এইসব জ্ঞানী মানুষদের কথা মনে পড়ে এখন। এখন অনেক বাসায় লক্ষাধিক টাকার সোফা, বড় এলইডি টিভি, দামী কার্পেট, ল্যাপটপ, ট্যাব, কম্পিউটার এবং ছোট বড় প্রত্যেক সদস্যের হাতে দামি মোবাইল দেখি। কিন্তু খুঁজে কোথাও বই দূরে থাক একটি দৈনিক পত্রিকাও পাইনা। আমাদের পরিবার গুলো যদি আত্মিক দিক দিয়ে এত দৈন্য হই তবে সন্তানগুলোর কি হবে ? তারপরও কেন জানি হবিগঞ্জের এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো মনকে নাড়া দিয়েছে। সবাই মিলে আমাদের সমাজ, পরিবার, সন্তানদের পরিবেশ রক্ষা করি। সোনার বাংলা গড়ার সাথে সাথে নিজেদেরও সোনার মানুষে পরিণত করি। মুজিব বর্ষে প্রার্থনা হোক-
‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’
এখন সময় এসছে শুধু ছেলে নয় মেয়েদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।