পাঠকের কলাম…
লিটন পাঠান
“ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ওই আমাদের গাঁ” ছোট বেলা এই কবিতা পড়া থেকে বাদ পড়েনি কেউ। মৌসুমী ফল তালের রসের পিঠা আমাদের দেশের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তাল গাছের ডাল ও পাতা দিয়ে হাতপাখা, ফুলের টব, বাজারের থলে ও অনেক সুন্দর দ্রব্য তৈরী করা যায়। “ভাদ্র মাসে গাছের তলায় ঝইরা পড়ে তাল, পাকা তালের মৌ-মৌ গন্ধে করে যে মাতাল”। তালের পিঠা বেজায় মিঠা খেতে ভারি মজা, ভাদ্র মাসের তালের পিঠা, খায় যে রাজা-প্রজা। বাংলা সাহিত্যে তাল নিয়ে অসংখ্য কবিতা, ছড়া ও গান রচিত হয়েছে। ভাদ্র মাস যেন বাঙালি জীবনের পাকা তাল ও তাল পিঠার মাস। কথায় বলে “ভাদ্রের তাল পাকা গরমে”। সম্ভবত এ মাসটিতেই তাল পাকে তাই এ গ্রাম বাংলা জুড়ে এই কথার প্রচলন দীর্ঘদিন ধরে। হবিগঞ্জের মাধবপুরে গাছে গাছে এখন পাকা তালের মৌ মৌ গন্ধ মুখরিত করছে চারদিক। আর বাড়িতে বাড়িতে চলছে তাল পিঠা তৈরীর উৎসব। চলছে জামাই ও আত্মীয় স্বজন আপ্যায়ন। খাদ্য রসিক বাঙালি রসনা বিলাসের জন্য এ মাসেই তাল রসে তৈরি পিঠাসহ মুখরোচক নানা খাদ্য আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন। খুব ধৈর্য্য নিয়ে নারীরা তালের আঁশ থেকে নির্যাস বের করে তৈরি করছেন তালের চিতল পিঠা, কাঁঠাল পাতায় ভরে কলকি পিঠা, তাল পিঠা, তাল বড়া, তাল তেল, তালরুটি, তালের পায়েস, কলাপাতায় তাল পিঠা, তালের রসভরি সহ হরেক রকমের পিঠাপুলি ইত্যাদি। এক সময় মাধবপুরের প্রত্যন্ত জনপদে প্রচুর তালগাছ দেখা যেত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তালগাছ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। এককালে এ সময়ে গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে তাল পিঠা বানানোর ধূম পড়ে যেত। সারারাত ধরে পিঠা তৈরি করে সকালে তা প্রতিবেশিদের মাঝে বিলানো হত সেই পিঠা। সবাই আনন্দচিত্তে তৃপ্ত হত সে পিঠা খেয়ে। গ্রাম বাংলার কোনখানে এসব মন ভুলানো দৃশ্য এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত সুস্বাদু এসব তাল পিঠা ও সেই সাথে এর ঐতিহ্যও। গাছতলায় গিয়ে দল বেঁধে তাল কুড়ানো, সেই তালের রস নিয়ে পিঠা বানানো, তৈরি পিঠা নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিলানোর চিত্র এখন যেন স্মৃতির পাতায় বন্দি হতে চলেছে। এ ব্যাপারে মনতলা শাহজালাল সরকারি কলেজের প্রভাষক আক্তার হোসাইন জানান, তার বাড়িতে প্রাচীন একটা তাল গাছ আছে। বড় জাতের এই তাল খুবই সুস্বাদু। তাল পাকলেই আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে পাঠানোর ঐতিহ্য এখনও আছে তার পরিবারে। আর প্রতিবেশিরাও পাকা তাল নিয়ে পিঠা তৈরী করে খায়। পূর্ব মাধবপুর গ্রামের মানিক মিয়া জানান, জ্যৈষ্ঠের শুরুতেই এখন শাস যুক্ত প্রায় সব তাল বিক্রি করে দেয়া হয় তাই পাকা তাল খাওয়ার সুযোগ খুব একটা হয়না। শাস ব্যবসায়ীরা পুরো গাছ ধরে ক্রয় করে নিয়ে যায়। এক সময় তাল পাকানো হত, বোন ভাগ্নির বাড়িতে তা পাঠানো হত। বেশির ভাগ তাল বাগান মালিকরা শাস বিক্রি করে থাকেন। তাই বাজারে ৪০ থেকে ৫০ টাকার নিচে ভালো পাকা তাল পাওয়া যায়না। তবে বেশি বেশি তালগাছ লাগালে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, তাল গাছ শুধু প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে না বরং বজ্রপাত নিরোধক হিসেবেও কাজ করে। তাই বেশি করে তাল গাছ লাগানো হলে এ দেশ আরো সমৃদ্ধশীল হবে এবং কাঠের চাহিদা পূরণ করবে।