ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
আমার জন্মভূমির স্বাধীনতার কথা বলছিলাম, স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। নিপীড়কের হাত থেকে নিপীড়িতের, শোষকের হাত থেকে শোষিতের, স্বৈরাচারীর হাত থেকে নিগৃহীতের, লুঠেরাদের হাত থেকে লুণ্ঠিতদের মুক্তির কথা।
মাত্র ন’টা মাসে হাল্কা অস্ত্র নিয়ে প্রায় শত সহ¯্রাধিক তথা লক্ষাধিক চৌকস সেনাবাহিনীর বিপরীতে মুষ্টিমেয় মুক্তিযোদ্ধাদের এমনতর ত্বড়িৎ বিজয় পৃথিবীতে বিরল। দুই যুগেরও অধিককাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে তামিল গেরিলারা সফলকাম হতে পারেনি। ভিয়েতনাম মুক্ত হতে কম সময় এবং কম নরবলি ও কম রক্তক্ষরণের সম্মুখীন হয়নি। আমাদের স্বল্প সময়ে জয়লাভের প্রধান কারণ ছিল জাতির প্রায় শতভাগ নৈতিক সমর্থন এবং সক্রিয় সহযোগিতা। যতদূর মনে পড়ে, স্বাধীনতাত্তোরকালে সমগ্র জাতির মাঝে যে আবেগঘন আনন্দ উল্লাস, উচ্ছাস এবং এক মহামিলনের সুখময় অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা বহুদিন পর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সমাগমের বা মিলনমেলারই মত। হয়ত প্রতিটা জাতির স্বাধীনতা উত্তরকালে এমনটাই হয়।
দ্বিতীয়ত আমরা সেই গৌরবময় জাতি যারা নিজের মায়ের ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায় করেছি। ইতিহাসের পাতায় রক্তের অক্ষরে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ খোদাই করে লিখে রেখেছি। শুধু তাই নয়, আমরা আমাদের মাতৃভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মর্যাদা প্রদানে সক্ষম হয়েছি। উত্তর প্রজন্মের কাছে এটা আামাদের আত্মগরিমার ইতিহাস, আত্মসম্মানের ইতিহাস। এ ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে আমরা যোগ্য পূর্বসুরি ছিলাম। যেমন করে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন, আবদুল ওহাব, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, তিতুমীর, ফকির মজনু শাহ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন তেমনি করে ভাষা আন্দোলন ও গণআন্দোলনে রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, আসাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোন অনকাশ নেই।
আয়তনে আমাদের দেশটা ক্ষুদ্র হলেও জনশক্তিতে আমরা অনেক শক্তিশালী, ভাষাগত দিক থেকে পৃথিবীর অষ্টম জাতি। অতঃপর একটা প্রাচীন, সমৃদ্ধশালী, আবেগপূর্ণ ভাষা হিসেবে বাংলাভাষা পৃথিবীর অন্যতম গৌরবময় ভাষা।
আমার এতগুলো কথার সূত্রপাত এবং অবতারণা এজন্যই অতীতের আত্মপ্রত্যয়ী, দেশপ্রেমিক এ সকল বীরযোদ্ধাদের এসব ত্যাগ, তিতিক্ষা, আত্মবলিদানের একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদগণ ও বীরাঙ্গনাদের ভূমিকার গুরুত্বও যে পূর্ববৎ আন্দোলনের মতই একই সমতলে বরং বহুলাংশে বেশি তা পুনর্বিবেচনার কোন প্রয়োজন নেই।
বড় বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করা হয়ছিল। লুটেরা, কালোবাজারি, মজুতদার, মুনাফাখোর, ভিনদেশে দেশের অর্থ-সম্পদ পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই দেশটাকে হায়েনা কবল মুক্ত করা হয়েছিল। এদেশের অর্থ ভিনদেশে স্থানান্তর করে সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম তৈরি করার জন্য নয়। ভিনদেশে সাহেবপাড়া বা বেগমপাড়া প্রস্তুত করার জন্য নয়। এদেশের কৃষক, কুলি, মজুর, কামার, মুচির ঘাম ঝড়ানো করের টাকা লুটপাট করার জন্য নয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পরপর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। রেডিও, পত্রিকায় উনার অনেক বক্তব্য শুনেছি, পড়েছি। বঙ্গবন্ধুকে প্রায়শই বলতে শুনতাম, ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী’।
স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও সে চুরি, লুটপাট, কমিশন বাণিজ্য বন্ধ হয়নি।
একটা কুট কৌশলে এক এবং একক একটা জাতিকে অপরাজনীতির মাধ্যমে, ভুয়া সাম্প্রদায়িক উস্কানির ধূয়া তুলে বিভাজন সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য।
আরে এদেশটাতো বংশ পরম্পরায়, পিতা, পিতামহ, দাদা, পরদাদা সকল সময়েই আমাদের। সবার নাড়ি এদেশেরই ভূগর্ভে প্রোথিত। দেশপ্রেম, নাড়ির টান নকল বা ভুয়া থিউরি দিয়ে চিহ্ন করা যাবে না। এ বন্ধন, এ সম্প্রীতিতে ফাটল ধরানো যাবে না। সাময়িক ফায়দা হাসিল হলেও এ জাতি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং বেইমানি ক্ষমা করবে না। আজ পর্যন্ত ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি।
আবারও বলছি, এদেশ আমদের পূর্বপূরুষের, আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের। এর মান, সম্মান, সার্বভৌমত্ব আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে।
কারণ এ যে আমার দেশ।
সে যে আমার জন্মভূমি ॥
বঙ্গবন্ধুকে প্রায়শই বলতে শুনতাম ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী’
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com