প্রতিটি পরিবারে শোকের মাতম ॥ এমপি আবু জাহিরসহ বিভিন্ন মহলের শোক ॥ দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রেলপথ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এমপি মিলাদ গাজী

এসএম সুরুজ আলী ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় হবিগঞ্জের ৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে এলাকার পরিবেশ। নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে। নিহতরা হলেন হবিগঞ্জ শহরতলীর বড় বহুলা গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আলমগীর আলমের ছেলে মাদ্রাসা ছাত্র ইয়াছিন আরাফাত (১১), আনোয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি লিটল ফ্লাওয়ার কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ আলী মোহাম্মদ ইউসুফ, বানিয়াচং উপজেলা সদরের তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়ার আড়াই বছর বয়সী শিশুকন্যা আদিবা আক্তার সোহা, একই উপজেলার বড়ইউড়ি ইউনিয়নের মদনমুরত গ্রামের আল-আমিন, চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা ইউনিয়নের উলুকান্দি তালুকদার বাড়ির ফটিক মিয়া তালুকদারের ছেলে রুবেল মিয়া তালুকদার (২৫), একই উপজেলার মিরাশী ইউনিয়নের পীরেরগাও গ্রামের মৃত আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া (৩০), একই উপজেলার আহমদাবাদ গ্রামের পেয়ারা বেগম (৬৫), হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দাবাদ গ্রামের আজমত উল্লাহর ছেলে রিপন মিয়া (৩০) ও নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে নজরুল মিয়া (২৩)।
নিহত আল-আমিনের চাচা বানিয়াচঙ্গের বড়ইউড়ি ইউপির সাবেক মেম্বার কুতুব উদ্দিন জানান, আল-আমিন চট্টগ্রামে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। ১৯ দিন পূর্বে তার এক ছেলের জন্ম হয়। ছেলের নাম রাখতে তিনি সম্প্রতি বাড়িতে আসেন। একমাত্র ছেলের নাম রাখেন ইয়ামিন। এছাড়া রনিহা (৬) ও নুছরা (৮) নামে তার দুই মেয়ে রয়েছে। ছেলের নাম রেখে চাচা মনু মিয়া ও ফুফাতো ভাই শামীমকে নিয়ে সোমবার রাতে উদয়ন ট্রেনে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রেল দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। অপর দুইজন মনু মিয়া ও শামীম গুরুতর আহত হন। নিহত আল-আমিনের কোন ভাই-বোন নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন মা-বাবাও।
বানিয়াচং উপজেলার তাম্বুলিটুলা গ্রামের সোহেল মিয়া জানান, তিনি ও তার স্ত্রী নাজমা বেগম চট্টগ্রামের একটি কোম্পানীতে চাকরি করেন। বৃহস্পতিবার তারা বাড়ি আসেন। সোমবার স্ত্রী ও ২ সন্তানকে নিয়ে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে ট্রেন দুর্ঘটনায় আড়াই বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে আদিবা আক্তার সোহা মারা যায়। আহত হন তিনি, তার স্ত্রী ও সাড়ে ৪ বছর বয়সী ছেলে নাছির। তারা এখন ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেয়ের মৃত্যুতে নির্বাক হয়ে পড়েছেন নিহত সোহার মা-বাবা।
হবিগঞ্জ শহরের আনোয়ারপুর গ্রামের আব্দুল আহাদ জানান, তার চাচাতো ভাই আলী মোহাম্মদ ইউসুফ বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করে স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী চিশতিয়া বেগম চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী ও দেড় বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে ইশা আক্তারকে বাড়িতে আনার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হবিগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক রুবেল আহমেদ চৌধুরী জানান, নিহত আলী মোহাম্মদ ইউসুফ জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি ৪ চার ভাই বোনের মধ্যে তৃতীয়। তার বাবা মারা গেছেন ২০১১ সালে। আর বড় ভাই উসমান গনি ২০১৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এখন ইউসুফই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তিনি ট্রেনের এই দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান। দুপুরে ইউসুফের বাড়িতে যান জেলা বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পদত্যাগকারী মেয়র জি কে গউছ ও বর্তমান মেয়র মিজানুর রহমান মিজান। এ সময় বিএনপি নেতা জি কে গউছ জানান, আলী মোহাম্মদ ইউসুফের মৃত্যুতে বিএনপি’র অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনা সাধারণত এমনিতেই হয় না। দুর্ঘটনায় কারো না কারো গাফিলতি ছিল। আমি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো তদন্ত করে এর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। এ ব্যাপারে পৌর মেয়র মিজানুর রহমান মিজান জানান, আলী মোহাম্মদ ইউসুফ অত্যন্ত ভাল মানুষ ছিল। তার অকাল মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাগে আমি ও আমার পৌর পরিষদ শোকাহত।
ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন শহরতলীর বড়বহুলা গ্রামের আলমগীর আলমের ছেলে ইয়াছিন আরাফাত (১১)। বাবার সাথে চট্টগ্রামে যাচ্ছিল সাগর ও দর্শনীয় স্থান দেখতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। আহত হন তার বাবা হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও বহুলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আলমগীর আলম। নিহত ইয়াছিন ওই প্রাইমারী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। সে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য ছিল। ছেলেকে হারিয়ে তার মা হাসিনা আক্তার বার বার মুর্চা যাচ্ছেন।
বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজারে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা গ্রামের রুবেল মিয়া তালুকদার। সে ওই গ্রামের পশ্চিম তালুকদার বাড়ির ফটিক মিয়া তালুকদারের ছেলে। সে স্থানীয় শানখলা মাদ্রাসার দাখিল শ্রেণীর ছাত্র। ট্রেন দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবারসহ পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
একই উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের সুজন মিয়া চাকরির ইন্টারভিউ দিতে চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। নিহত সুজন হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজে অনার্সের ছাত্র। পাশাপাশি তিনি হবিগঞ্জে মোহরার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ওই গ্রামের আবুল হাসিম মিয়ার ছেলে। চার ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
চুনারুঘাট উপজেলার আহমদাবাদ ইউনিয়নের ছয়শ্রী গ্রামের আব্দুস সালামের স্ত্রী পেয়ারা বেগম সোমবার রাতে পিত্রালয় নোয়াখালি যাচ্ছিলেন। একাই তিনি বাড়ি থেকে রওয়ানা হন। পথে উদয়ন ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। তার ৪ সন্তান রয়েছে। খবর পেয়ে সকালে তার স্বামী আব্দুস সালাম লাশ আনতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান। বিষয়টি জানিয়েছেন আহমদাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত চৌধুরী।
নিহত রিপন মিয়া চট্টগ্রামে ব্যবসা করতেন। কয়েকদিন আগে তিনি বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। রিপনের চাচা নুরুল ইসলাম জানান, বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরার পথে তিনি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান।
নিহত নজরুল মিয়া (২৩) নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের হারুন মিয়ার ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন শ্রীমঙ্গলে একটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় শ্রীমঙ্গল এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হলে পড়ালেখা বাদ দিয়ে ওই ব্যক্তির ব্যাটারী চালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মঙ্গলবার সকালে নিহতের মা জ্যোৎ¯œা বেগমের মোবাইলে শ্রীমঙ্গল থেকে এক লোক মৃত্যুর সংবাদ জানায় এবং শায়েস্তাগঞ্জ থানার এক পুলিশ অফিসারের মোবাইল নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। সাথে সাথে জ্যোৎ¯œা বেগম শায়েস্তাগঞ্জ থানায় ওই পুলিশ অফিসারের মোবাইলে যোগাযোগ করলে পুলিশ ঘটনা নিশ্চিত করে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহতের মরদেহ শনাক্তের জন্য অনুরোধ করেন। সাথে সাথে নিহত নজরুলের পিতা হারুন মিয়া ও মা জোৎ¯œা বেগম রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে তাদের ছেলে নজরুল মিয়ার লাশ শনাক্ত করেন।
এদিকে, দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রেলপথ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের এমপি গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ গাজী।
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, নিহতদের লাশ দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ফলে আহতদের তালিকা করা সম্ভব হচ্ছে না। আহতদের চিকিৎসার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।