যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অজ্ঞান অবস্থায় দেড় বছর কাটিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যখন দেখে তাঁর সুন্দরী স্ত্রীকে তারই মাতা পিতা অপেক্ষার পর স্বেচ্ছায় অন্যের হাতে তুলে দিয়েছেন এর চেয়ে করুণ কাহিনী আর কি হতে পারে

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

দেশাত্মবোধক গানের কথা বলছিলাম। হ্যা আমার দেশের গান, বাংলাদেশের গান, আমারই জন্মভূমির গান। যা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে কাঁপন ধরানো এক অদৃশ্য তড়িৎ প্রবাহ। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কেন, সমগ্র জাতির চেতনায় স্পন্দন সৃষ্টিকারী এক বলিষ্ঠ উদ্দীপনা। সমগ্র জাতি যখন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে নানাবিধ শোকে শোকাভিভূত তখনো দেশাত্মবোধক গান জাতির আবেগকে কম আন্দোলিত করেনি।
শিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহর আবেগতাড়িত কণ্ঠের..
‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে
রক্তিম সূর্য আনলে যারা,
তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না;
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাত কোটি মানুষের জীবনের সন্ধান আনলে যারা,
সে দানের মহিমা কোনদিন ম্লান হবে না।’ গানে তৎকালীন সময়ে কোন শ্রোতার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়নি এমনটা ছিল বলে আমার মনে হয় না।
প্রতিভাবান গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অনবদ্য সৃষ্টি
‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়,
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু, দোয়েল ডাকে মুহু মুহ; নদী যেথায় ছুটে চলে আপন মহিমায়’
একজন বাঙালি বা বাংলাদেশীর দেশপ্রেমকে সত্যিকার অর্থেই চাঙ্গা না করে পারেনি।
তেমনি করে…
‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারামন,
শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে নেই কোন প্রয়োজন’
‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল,
আমাকে তুই বাউল করে সঙ্গে নিয়ে চল’
‘জন্ম আমার ধন্য হল মাগো
এমন করে আকুল হয়ে
আমায় তুমি ডাকো’
এসকল কালজয়ী গান সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেমে শুধু একাত্মই করেনি, সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে উৎসাহ যুগিয়েছিল দারুণভাবে।
যা বলছিলাম, অধিকার বঞ্চিত বাঙালিদের যখন শোষণমুক্ত হতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার আর কোন বিকল্প ছিলনা, ধৈর্য যখন সীমা অতিক্রান্ত হয়ে পড়েছিল, তখন বাংলার পাগলপারা দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখেই বন্দুক হাতে নিয়েছিল। মা, স্ত্রী, সন্তানের কাছে কোনদিন ফিরে আসতে পারবে এ প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। একটা সম্পূর্ণ স্বাধীন, শোষনমুক্ত, গণতান্ত্রিক, সুন্দর দেশের আশায় মরণকে হাসিমুখে বরণ করতেই অনির্বাণ পণ করেছিল। চৌদ্দ-পনের বছরের একজন কিশোর হিসেবে এতটুকু বুঝার সক্ষমতা আমার মত ক্ষুদে নাগরিকদেরও যে হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
উনসত্তরের গণআন্দোলনে মিছিলে সক্রিয় অংশগ্রহণ, একাত্তুরের ষোলই ডিসেম্বরে পতাকা হাতে গ্রামবাসীদের নিয়ে লাফালাফি এবং আনন্দোচ্ছ্বাস আজো স্মৃতিতে অম্লান।
ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও আড়াই লক্ষ বীরাঙ্গনার বদৌলতে প্রাপ্ত এদেশটাকে নিয়ে তখন অনেক স্বপ্ন ছিল, অনেক সাধ ছিল, অনেক প্রত্যাশা ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধু শহীদদের রক্ত এবং মা-বোনদের ইজ্জতহানি নয়, অনেক সকরুণ কাহিনীও জড়িত আছে। অনেক অশ্রু নিঃস্বরণের ইতিহাস আছে কালো অধ্যায়কে ধারণ করে।
একমাত্র সন্তান মায়ের বাড়া ভাত রেখে দিয়ে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ঘরে ফিরেনি এমন অনেক নজির রয়েছে। এক মা তাঁর সন্তানের অপেক্ষায় আমৃত্যু অন্ন স্পর্শ করেননি, ফিরে আসার আশায় আজীবন রোজা রেখেছেন কিন্তু সন্তানের ফেরা হয়নি কখনো। লোকচক্ষুর অন্তরালে বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে প্রেয়সীর হাত নেড়ে তার প্রিয়তমকে বিদায় যে জীবনের শেষ বিদায় ছিল, এমন উপমা ভুঁড়ি ভুঁড়ি।
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অজ্ঞান অবস্থায় দেড় বছর কাটিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যখন দেখে তাঁর রেখে যাওয়া নতুন অনুপমা সুন্দরী স্ত্রীকে তারই মাতা পিতা অপেক্ষার পর স্বেচ্ছায় অন্যের হাতে তুলে দিয়েছেন এর চেয়ে করুণ কাহিনী আর কি হতে পারে।
এতসব আত্মত্যাগ, সম্ভ্রমহানি, বিরহগাঁথা সেতো ছিল বুর্জোয়া বাইশ পরিবারের কবলমুক্ত হয়ে শোষনমুক্ত, লুঠেরামুক্ত, সামরিক ও স্বৈরশাসনমুক্ত সত্যিকারের একটা স্বাধীন দেশের আস্বাদন লাভের জন্য। এ সকল ত্যাগ ছিল প্রাণ খুলে চিৎকার করে মনের আকুতি, অনুযোগ প্রকাশ করার জন্য। ছিল নতুন প্রজন্মের হাতে সর্বোতভাবে স্বাধীন সার্বভৌম একটা নিষ্কণ্টক রাষ্ট্র উপহার দেয়ার জন্য।
সব কষ্ট, তিতিক্ষা ছিল আমারই এই দেশটার জন্য, আমারই এই তৎকালীন হতভাগা জন্মভূমির জন্য।
সে যে আমার জন্মভূমি ॥