তাহমিনা বেগম গিনি
আশির দশকে বিদেশে ছিলাম সপরিবারে। বিদেশের টি.ভি, প্রিন্ট মিডিয়ায় সে সময় বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হতো ঝড়, বন্যা দুর্যোগ, মহামারী, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অশিক্ষা ইত্যাদির ছবি দিয়ে। খুব খারাপ লাগতো যখন খালি গা, খালি পায় হাড় জিরজিরে বাচ্চাদের ছবিগুলো দেখতাম। বন্যা, জলোচ্ছাসে ঘরবাড়ি বিলীন, ভাঙ্গাচোরা এমন সব অসহায় নারী পুুরুষের ছবি দেখতাম, সামান্য ত্রাণের জন্য হাজার হাজার হাত বাড়িয়ে আছে। অনেকে আমাকে দেখে ভাবতো এবং বলতো তোমরা এত গরীব? তখন বিদেশে খুব কষ্ট হতো এই ভেবে, কেন আমার দেশের ভালো জিনিসগুলো, সুন্দর দেশটাকে, সংস্কৃতিকে, ভালো মানুষগুলোকে উপস্থাপন করা হয় না? কেন আমাদের দৈন্যতা দেখাতে হবে? এরপর বর্তমান-কত বছর মাস পেরিয়ে গেল, কত গদী ওলট পালট হলো, কত রাজা রানী এলেন গেলেন, কত নব নব ইতিহাস রচিত হলো। আজ আমরা কিছুটা হলেও মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারি, বাংলাদেশকে বিশ্বে এখন সবাই চেনে জানে। এখনো সিডর, আইলা হয়-আমারাই প্রতিরোধ করি। এখনো খালি গা, নগ্ন পা, অপুষ্টি শিশু চোখে পড়ে তবে সংখ্যা অনেক কম, গ্রামে গঞ্জে গেলে চোখে পড়ে দূর থেকে রোদ পড়ে চকচক করা অনেক অনেক টিনের চাল। শিক্ষায় আমরা এগিয়েছি কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশ শিরোনাম হয় আবরার হত্যার জন্য, নুসরাত, বিশ্বজিৎ হত্যার জন্য। গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, শিশু নির্যাতনের জন্য। এক টাকা এবং এক কাপ চা এর জন্য দাঙ্গা হয়। প্রাণ যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতির জন্য এবং সর্বশেষ সংযোজন ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু তুহিনের নির্মম, নৃশংস হত্যার জন্য। কেউ কেউ বলতে পারেন সমগ্র পৃথিবীতে আর কোথাও কি এমন হয় না? হতে পারে- কিন্তু যখন আমরা একটা একটা করে উন্নতির সিঁড়ি অতিক্রম করছি তখন কেন হবে? সেই আগে প্রাকৃতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে আমাদের দৈন্যতা ছিল, আমরা চেষ্টা করেছি পূরণ করতে, কিন্তু মনুষ্যত্বের দৈন্যতা, মানবিক অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতন, সম্পর্কের টানাপোড়েন, এগুলোর কিভাবে সমাধান হবে? সমাজের লোভ-ভোগবাসনা, হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস-নিষ্ঠুরতার প্রবল পরাক্রমের কাছে মনুষ্যত্ব ও বিবেক, চেতনা ও বোধশক্তি, মমতা ও সহানুভূতির প্রকাশ চাপা পড়ে যাচ্ছে। বহু মানুষের ত্যাগে যখন দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান হয়েছে তখনি মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে সংকট ও ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠেছে। যার পরিণতিতে দেখছি ছাত্র, ছাত্র সংগঠন কর্তৃক ঘটিত লোমহর্ষক হত্যাকান্ড। নৈতিকতার জায়গা থেকে সরে আসছে মানুষ। বাবা শিশুকে ঘুম থেকে তুলে নিজের একান্ত নির্ভয়, নির্ভার আশ্রয়স্থল পিতার কোল, সেখানে বাবা চাচাদের দ্বারা খুন হয়েছে শিশু তুহিন। পিতা কর্তৃক কন্যা ধর্ষণ, মাতা কর্তৃক শিশু হত্যা, সন্তান কর্তৃক পিতা মাতা হত্যা আজকাল যেন মাছ-ভাত হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র বিচারহীনতা এসবের জন্য দায়ী। ঘটনাগুলোর ভয়াবহতা অনুধাবন করে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশু হত্যা সহ সব রকম হত্যার জন্য কঠোর আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রুতবিচার নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সময়ে শিক্ষা পথ হারিয়ে বিপদগামী। রাজনীতি আদর্শ ও নীতিহীন হয়ে ক্ষমতার অন্ধ অনুসারি। সমাজ ক্ষমতাবানদের দাপটে সন্ত্রস্ত হয়ে অপরাধীর সঙ্গে বসবাসে অভ্যস্থ। এসব থেকে যদি আমরা পরিত্রাণের রাস্তা না খুঁজি, তবে উন্নতির যে চাকচিক্য- তা ঢাকা পড়ে যাবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শেষ করছি- রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “স্বাধীনতা সংগ্রাম আদতে মনুষ্যত্ব অর্জনের সংগ্রাম”।