ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
আঙুল ফুলে হঠাৎ করে কলাগাছ বনে গেলেন? অথবা অজৈব সার প্রয়োগে বাড়ন্ত উদ্ভিদের মত ত্বড়িৎ অস্বাভাবিক উঁচু হয়ে গেছেন বলে মনে হয়? গাড়ি, বাড়ি, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব প্রতিপত্তি সবকিছু মিলিয়ে রাজাধিরাজ ভাবছেন? চারিপার্শস্থ চাটুকারেরা মিথ্যা প্রশংসায় পঞ্চমুখ? আমজনতা যখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে সালাম টুকেন তখন খুব আচ্ছা একজন মনে হয়?
যা বলছিলাম, এগুলো কিন্তু আদৌ কোন সুখকর বিষয় নয়। আপাতদৃষ্টে লাভজনক মনে হলেও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর এক মহিরুহের বীজ বপন করে গেলেন। নিশ্চয়ই অতীত ইতিহাস কিছুটা হলেও যতœসহকারে অধ্যয়ন করেছেন। হিটলার, হিমলার, স্ট্যালিন, চেঙ্গিস খাঁন, হালাকু খাঁনদেরকে মানুষ কিন্তু আজো ভুলেনি। তেমনি মীর জাফর আলী খাঁনকেও ভুলতে পারেনি মানুষ। তার পরম্পরা বংশধরদের প্রতিও মানুষ অদ্যাবধি ঘৃণা পোষণ করে আসছে বৈ কি।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র কি তা জানেন? প্রতিটি কর্মেরই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। অতএব প্রতিটি খারাপ এবং ভাল কাজের প্রতিদান সমভাবে ফেরতযোগ্য। ছোট কাজের ছোট প্রতিদান, বড় হলে বড়। একসময়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আমজনতার ঘৃণা আর অভিশাপে অনেকেই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন এমন নজির ইতিহাসে মোটেই বিরল নয়।
পদার্থ বিজ্ঞানের আরেকটি সূত্র রয়েছে। যে পদার্থ ত্বড়িৎ তাপ গ্রহণ করে ত্বড়িৎ অধিক গরম হয় তা কিন্তু আবার ত্বড়িৎ তাপ বিকিরণ করে তাড়াতাড়ি ঠান্ডাও হয়ে যায়। সুতরাং অসৎ উপায়ে বিত্ত-বৈভব, পেশীশক্তি এবং অন্যায় অবিচারে ত্বড়িৎ মহা ক্ষমতাধর হয়ে গেলেও জেনে রাখুন পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রমতে পতনও ত্বড়িৎ এবং অবশ্যম্ভাবী। লাভ এটুকুই নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে কেবল কলংকিত করে গেলেন মাত্র। কর্মের দায়ভার তাদের উপর অর্পন করে গেলেন শুধু। নিজের প্রবাহিত রক্তের উত্তরসূরিরাই একদা ঘৃণা করবে। অতীত বংশপরিচয় তুলে ধরতে কুণ্ঠাবোধ করবে। অথচ দায়ী কিন্তু সে মোটেও নয়। একজন প্রয়াত ভাল, সদ্জন ব্যক্তির উত্তরসূরিদেরকে মানুষ যেমন আদর, স্নেহ, সম্মান করে শ্রদ্ধাভরে উল্টোভাবে অসৎ ব্যক্তির কৃতকর্মের ফলে তার উত্তরসূরিদের এই আমজনতা কেবল ঘৃণা এবং অসম্মানই করে।
আজ চারিপাশে যে চাটুকার, তৈলমর্দনকারী, স্বার্থান্বেষী মহল সামান্য মুনাফার লোভে পঞ্চমুখ দেখবেন পতনকালে তারা কি সুন্দর মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আরে, প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে মানুষত নিজের অতি প্রিয় বস্তুটাকেও ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে। সুতরাং আমি আপনিত কোন্ ছাড়! চক্ষুলজ্জায় সম্মুখে তোষামোদ নয় বরং অগোচরে সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিজ্ঞ সুশীলগণ কি ধারণা পোষণ করেন আসুন ছদ্মবেশে হযরত উমরের (রাঃ) ন্যায় উদঘাটন করি। কৃতকর্মের ফলাফল শুধু ওপারে নয় এপারেই একদিন নগদ সাক্ষাত হাজিরা প্রদান করবে। খেলা শেষ হলেও তখন আর বেলা থাকবে না যে। ইতিহাসটানা বড়ই নির্মম। আজ পর্যন্ত কাউকেই ক্ষমা করেনি এবং করবেও না।
কেন বলছি জানেন? এই ছোট্টখাটো সম্ভাবনাময় দেশটা আপনার, আমার এদেশের সকলের। সকলেরই বাপ-দাদা এবং পূর্বপুরুষের। সতের কোটি মানুষের। সতের কোটি মানুষের নাড়িটা এদেশেরই মাটিতে পোঁতা রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা শতকরা নিরানব্বই জনই একক শক্তি ছিলাম। আমাদের অতীত ইতিহাস স্বর্ণোজ্জ্বল। নিজের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে আত্মাহুতির ইতিহাস আর কোথাও নেই। অসম শক্তির সাথে যুদ্ধ করে মাত্র ন’মাসে স্বাধীনতা লাভের নজির বিশ্বের আর কোথাও নেই। অতএব জনগণকে বোকা ভাবার কোনই সুযোগ নেই। কাক নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে চোখ বুঝে মরিচ চুরি করতে পারে এই ভেবে যে কেউ হয়ত দেখেনি কিন্তু সে যে নিজেই বোকা তা অনুধাবন করার ক্ষমতা আসলে তার নিজেরই নেই। আমার আপনার চেয়ে জ্ঞাণী এবং দেশপ্রেমীদের সংখ্যা কিন্ত অনেক বেশি। সুতরাং এ সকল দেশপ্রেমীদের নিয়েই এগুতে হবে। ধর্ম, বর্ণ, ধনী গরীব সকলকেই ভালবাসতে হবে। সার্বজনীন জনপ্রিয়তা ছাড়া দীর্ঘকালীন টিকে থাকার আর কোন সূত্র আছে বলে আমার জানা নেই। নচেৎ নিজেকেই একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হতে পারে।
সততার কোনই বিকল্প নেই। সিঙ্গাপুরের কিং লি কুয়ান শুধু সৎ এবং মেধাবীদের নিয়ে দেশটাকে মাত্র দু’কুড়ি বছরে সোনার দেশ বানিয়ে ফেলেছেন যার অবস্থা আমাদের চেয়েও একসময় খারাপ ছিল। তিনি শিক্ষা এবং মেধার চেয়ে সততাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আজ উনার দেশে উনি একজন দেবতুল্য। এমন একটা মাতৃভূমি থাকতে এদেশের অর্থ-সম্পদ পাচার করে সেকেন্ড বা থার্ডহোম তৈরি করে বিদেশ বিভুইয়ে অসম্মানজনক তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব লাভ মোটেও সম্মানের নয়, নয় গৌরবেরও। আরে, মোর কাঁচা ঘর খাসা।
‘যেসব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী,
সেসব কাহার জন্ম নির্ণেয় ন’ জানি।’
তাই আসুন, বিভাজন নয় সকল জনসাধারণকে ভালবেসে নিখাদ দেশপ্রেম এবং সততাকে অবলম্বন করে দেশটাকে এগিয়ে নেই। প্রতিহিংসা নয়, সত্যিকারের ভালবাসা দিয়ে জনগনের মন জয় করি। প্রতিশোধ নয় ক্ষমার নীতিকে অনুসরণ করি। স্বাধীনতাত্তোরকালে বঙ্গবন্ধু প্রায়শঃই একটা কথা বলতেন ‘চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী’। আসুন বঙ্গবন্ধুর বদ্ধমূল এ ধারণাটাকে আমরা এখন মিথ্যায় পর্যবসিত করি। ভুলত মানুষেরই হয়, আসুন সংশোধিত হই। ভুল স্বীকার দোষের নয়, বরং একটা মহৎ গুণ। নিজাম উদ্দিন ডাকাত ভুল স্বীকার করেই একদিন আউলিয়া হয়েছিলেন।
আসুন সাধু সেজে দেশের ক্ষতি সাধন না করে এখনো সময় থাকতে সাবধান হই। এতে নিজেরই লাভ হবে, লাভ হবে নিজেরই উত্তরসূরিদের। সাথে সাথে লাভ হবে আমাদের ছোট্ট এ সোনার দেশটার, লাভ হবে দেশের সহজ সরল নির্লোভ জনসাধারণের ॥