ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
তখনো স্নাতকোত্তোর কোন ডিগ্রি কপালে জোটেনি। তবে চেম্বারে জোয়ারের উর্দ্ধগতি চলছে। ভিড় সামলাতে বেশ সকালেই চেম্বারে চলে এসেছি। সবেমাত্র দু’তিন জন রোগী এসেছেন। বয়স্ক একজন শ্বাসকষ্টের রোগীকে প্রথমেই ডাকলাম। মনে হল সঙ্গে আসার মত প্রিয়জন কেউ নেই। সময় নিয়ে জামাকাপড় খুললেন। নজরে যা পড়ল তা হল প্রত্যেকটা বুকের পাজর গোনা যায়, অস্তচর্মসার অস্তাচলগামী এক অপেক্ষমাণ শেষ পথযাত্রী। ক্রনিক বা দীর্ঘদিন ধরে ভোগা শ্বাসকষ্ট রোগীরা আসলে এমনটাই দেখতে। প্রতিটা কর্মে গতি কমে আসে।
প্রেসক্রিপশন লেখার পরও জামা কাপড় গায়ে দিতে সময় নিচ্ছিলেন। বসে বসে এক সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবকে তার জীবনযুদ্ধের শেষ মুহূর্তগুলোর করুণাবস্থা অবলোকন করছিলাম যেন। ক্রমশ ম্রিয়মান বার্ধক্যপীড়িত এক কঙ্কালসার পশুরাজ সিংহেরই প্রতিচ্ছবি মনে হচ্ছিল। অথচ কোন এক সময়ে টগবগে যৌবনের দাপট, উচ্চ অথচ প্রকম্পিত কণ্ঠস্বর আশপাশ কিছুটা কাঁপিয়ে তুলত বৈ কি!
ততক্ষণে দ্বিতীয় রোগীকে ভেতরে ডাকা হল। স্ত্রী সমেত ময়লা চাদর মুড়ি দিয়ে ভদ্রলোক ঢুকলেন। অনেকদিন যাবৎ জ্বর কাশিতে ভুগছেন। কাপড়চোপড় আর অবয়বের অভিব্যক্তি থেকে বুঝতে এটুকু বাকি ছিল না যে অর্থনীতির যাতাকলে তিনিও দেশের একজন নিস্পৃষ্ট হতভাগা নাগরিক।
বয়স্ক প্রথম ভদ্রলোক দ্বিতীয় রোগীর স্ত্রীকে আস্তে আস্তে বার কয়েক জিজ্ঞেস করলেন, ওর কি হয়েছে? শরীরের এই অবস্থা কেন? ভদ্রমহিলা কোন উত্তর দিলেন না বরং কিছুটা বিরক্তিই বোধ করলেন মনে হল। এমনটা অস্বাভাবিক নয় কারণ মানসিক অবস্থা ভাল নয়, অতঃপর দুঃসময়ে অজানা লোকের অবান্তর প্রশ্ন অনেক সময় বিরক্তিই তৈরি করে।
দ্বিতীয় রোগী উত্তর দিলেন, ‘ভাই অনেকদিন যাবৎ জর কাশিতে ভুগছি, কাশির সঙ্গে মাঝে মাঝে একটু একটু রক্তও আসছে। টাকার অভাবে ডাক্তার দেখাতে পারছি না। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
কথা বার্তায় মনে হল উনাদের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। দ্বিতীয় রোগীকে দেখার পর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা লিখে দিলাম। বয়স্কজন তখনো অবনত মস্তিষ্কে বসে আছেন। ময়লা শার্টের ভিতরের পকেট থেকে দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট বের করলেন। একটা নোট আমার টেবিলের উপর রেখে আর একটা নোট দ্বিতীয় লোকটার হাতে দিলেন। বললেন, ‘আমার হাতেও টাকা পয়সা নাই। এটা তুই খরচ করে ফেলিস্। আমি যেভাবে পারি ঔষধ কিনব।’
ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মানবিক কারণেই হোক আর প্র্যাকটিস এর প্রসারের অভিপ্রায়েই হোক যতদূর মনে পড়ে এদের ফি ফেরত দিয়ে দিয়েছিলাম অবচেতন মনে।
তবে বিষয়টি নিয়ে অনেক্ষণ ভেবেছি। তারা দূর সম্পর্কের ভাই, নিজেও একজন শ্বাস কষ্টের রোগী। নিজের হাতের সম্বল একশত টাকা থেকে নির্দ্বিধায় অর্ধেক দিয়ে দিলেন। আমি কি আমার সরাদিনের উপার্জনের অর্ধেকটা কাছের বা দূরের অসহায় কাউকে এভাবে সহজে দিয়ে দিতে পারতাম বা কখনো দিতে পেরেছি?
আজো এ ক্ষুদ্র ব্যাপারটানা নিরবে নিভৃতে মনের দুয়ারে কড়া নাড়ে। ঝড় তোলে হৃদয়ের ঐ কোমল কোনে যেখানে লুকিয়ে আছে একটা ভাল মানুষ, ভাল একটা মন যা হাজারো স্বার্থপরতার মাঝেও নিঃস্বার্থ কিছু একটা করার সুযোগ খুঁজে। বয়োঃবৃদ্ধ দরিদ্র অথচ অশিক্ষিত মানুষটির কাছ থেকেও শেখার আছে এমন কিছু যা ঘুমন্ত ভালো মানুষটাকে জাগ্রত করতে পারে।