আমার জীবনে প্রথম টেলিফোনে ভাঙা ভাঙা গলায় চার পাঁচ মিনিট আলাপ করেছিলাম। আর আজকাল দু/তিন বছরের বাচ্চাও তখনকার আমার চেয়ে অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে ॥ ছেলে এবং মেয়েদের হোস্টেল একেবারে পাশাপাশি হলেও অনেক মজাদার ও ওজনদার চিঠি ডাক বিভাগের মাধ্যমেই চালাচালি হত। সিরাজ ভাই এটা ভাল করেই বুঝতেন। এ ব্যাপারে আমরা পীড়াপীড়ি করলেও কিছু বলতেন না শুধু মুচকি হাসতেন

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

উনিশশ’ ছিয়াত্তর থেকে বিরাশি। তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল এসএমএস অথবা ভিডিও চ্যাট। অফিস আদালত এবং কিছু ভিআইপি বাসা বাড়ি ছাড়া টিএন্ডটি ফোনের ব্যবহারও খুব একটা ছিল না।
আমার মনে আছে, উনিশশ’ চুয়াত্তর। এমসি কলেজ হোস্টেলের পাঁচটি ব্লকের মাঝামাঝি আমাদের থার্ড ব্লকের নিকটে সকলের সুবিধার্থে একটা টিএন্ডটি ফোনের ব্যবস্থা ছিল এজন্য যে, যদি বাড়ি বা বাসা থেকে কারো জরুরি কোন খবরাখবর আসে। হঠাৎ একদিন ডাক পড়ল আমার ফোন এসেছে। দৌঁড়ে গেলাম এবং ভয়ে বুক দুরুদুরু করতে লাগল দুটো কারণে, প্রথমত বাড়ি থেকে কোন খারাপ খবর এল কি না, দ্বিতীয়ত এটা আমার জীবনের প্রথম টেলিফোন, কিভাবে গুছিয়ে কথা বলি। যা হোক, যদিও তেমন কিছু ছিল না, বাহির থেকে এক বন্ধুর ফোন তবুও এটুক মনে আছে ঐদিন ভাঙা ভাঙা গলায় চার পাঁচ মিনিট আলাপ করেছিলাম। আর আজকাল দু/তিন বছরের বাচ্চাও তখনকার আমার চেয়ে অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারে।
ছিয়াত্তর তথা মেডিক্যাল হোস্টেল জীবনের কথা বলছি। যোগাযোগের মাধ্যম তখন কেবল বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। বাংলাদেশে কুরিয়ার সার্ভিসের তখনো জন্ম হয়নি। আমাদের কাছে চিঠিপত্র (পোস্টকার্ড/ইনভেলাপ) এবং মনি অর্ডার পৌঁছে দিতেন আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় সিরাজ ভাই। লম্বা, মাঝারি একহারা গড়ন, শ্যামলা সাতাশ আটাশ বছরের টগবগে যুবক। দাড়ি নেই অথচ মাথায় টুপি ছিল। হেসে হেসে সিলেটি টানা ভাষায় সুন্দর করে কথা বলতেন তাও আবার দৌঁড়ের উপর। হাতে একগাদা চিঠিপত্র। ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। আমরা কলেজ করে এসে খাওয়ার পর একটা ভাতঘুম দিতাম। ঘুম ভাঙলেই উঠে খুঁজতাম কারো চিঠিপত্র আসল কি না। সিরাজ ভাই সবার দরজার নিচ দিয়ে রুমের ভিতর ফেলে রেখে যেতেন। কোনদিন না পেলে মনটা খারাপ হয়ে যেত। ঘুমের সময় দরজায় টকটক শব্দ হলে ধরে নিতাম এটা সিরাজ ভাই। সম্ভবত মনি অর্ডার এসেছে। অন্য কেউ হলে ভীষণ রাগ উঠত। মেডিক্যাল হোস্টেলের দুপুরের ঘুমটা ভীষণ মুল্যবান। ঘুম বরবাদ তো রাত্রের পড়াও শেষ। কিন্তু সিরাজ ভাইয়ের উপর কাউকে কোনদিন সামান্যতম রাগ করতে দেখিনি। তেমনি পাশের মহিলা হোস্টেলেও সিরাজ ভাই সমধিক প্রিয়পাত্র ছিলেন।
হোস্টেলের প্রায় সকল ছাত্রছাত্রীর নাম সিরাজ ভাইয়ের মুখস্থ ছিল। কোন রুমের কার নিকট কি পরিমাণ এবং কোন ধরনের চিঠিপত্র আসে তার ধারণাও ছিল নিখুঁত। সিরাজ ভাইয়ের সাথে প্রথম দিকে সম্পর্ক একটু হাল্কা থাকলেও পাঁচ/ছয় বছরের এ ছাত্র জীবনে সবাই অত্যন্ত আপন হয়ে যেত। সিরাজ ভাই শুধু প্রিয়পাত্র ছিলেন না, ছিলেন বিশ্বস্তও। ছেলে এবং মেয়েদের হোস্টেল একেবারে পাশাপাশি হলেও অনেক মজাদার ও ওজনদার চিঠি ডাক বিভাগের মাধ্যমেই চালাচালি হত। সিরাজ ভাই এটা ভাল করেই বুঝতেন। এ ব্যাপারে আমরা পীড়াপীড়ি করলেও কিছু বলতেন না শুধু মুচকি হাসতেন।
একবার চীনদেশের একটা কাহিনী পড়েছিলাম।
দীর্ঘদিন ধরে দূর দুটো শহরের দুই ছেলে মেয়ের মাঝে পত্র বন্ধুত্ব ছিল অথচ তাদের কোনদিন দেখা হয়নি। একদিন চিঠি না আসলে মেয়েটা পাগলপারা হয়ে যেত। পোস্টম্যান জিম ব্যাপারটা উপলব্ধি করে তার কর্তব্যে একদিনও গাফিলতি করেনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করেও মেয়েটির নিকট সে চিঠি পৌঁছে দিত। বছর কয়েক পর মেয়েটি একদিন গভীরভাবে ভাবতে লাগল, যে ছেলেটি তার পত্রবন্ধু তাকেত সে কোনদিন চোখে দেখেনি, তার মেজাজ মর্জি শতভাগ মুখস্থ নয়, কর্তব্য পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার হার শতকরা কত সে অঙ্কও সে জানে না। অথচ এই পোস্টম্যান তথা জিম এত বছর যাবত তার কর্তব্যে সামান্যতম শিথিলতা প্রদর্শন করেনি, তার ভাল লাগার গুরুত্ব অনুধাবন করে যে মুল্যায়ন সে করেছে তার কোন তুলনা হয় না। সুতরাং তার চেয়ে বা তার মত ভাল মনের বিশ্বস্তজন এ পৃথিবীতে অন্য কেউ হতে পারে না। অতঃপর পরদিন যখন মেয়েটি জিমের গলা ধরে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে দিল পোস্টম্যান জিম তাকে জীবনসঙ্গী করতে আর না করতে পারেনি।
আমাদের সিরাজ ভাইও কম ছিল কিসের। কর্তব্যে তেমন গাফিলতি নজরে পড়েনি। বৃষ্টির দিনেও রেইন কোট গায়ে চিঠি বিলি করতে দেখেছি। ডাক হরকরাদের মত ডাক পিয়ন সিরাজ ভাইকেও দায়িত্ববোধের দিক থেকে একটুও কম মনে হয়নি।
হয়তো আমার মত অনেকের নিকট সিরাজ ভাই আজো তাদের স্মৃতিতে তেমনি ভাস্বর।