শুকনার দিনে বাড়ি থেকে অফিসে হেঁটে যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা এবং ফিরতে দেড় ঘণ্টা অর্থাৎ রোজ তিন ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচদিন হাঁটা ছিল নৈমিত্তিক অন্যরকম এক অনুভূতি

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

শুকনার দিনে বাড়ি থেকে অফিসে হেঁটে যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা এবং ফিরতে দেড় ঘণ্টা অর্থাৎ রোজ তিন ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচদিন হাঁটা ছিল নৈমিত্তিক
চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী লাভের পর প্রথম চাকুরীস্থল ছিল নিজেরই উপজেলায় এক সাবসেন্টারে বাড়ি থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে। প্রত্যন্ত অঞ্চল, বর্ষায় নৌকা এবং হেমন্তে হাঁটার বিকল্প নেই। প্রায় তিন যুগ পূর্বের কথা। বাড়িতে মা বাবার সান্নিধ্যে থাকার জন্য বাড়ি থেকেই অফিস করতাম। শুকনার দিনে বাড়ি থেকে অফিসে হেঁটে যেতে প্রায় দেড় ঘণ্টা এবং ফিরতে দেড় ঘণ্টা অর্থাৎ রোজ তিন ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচদিন এ হাঁটা ছিল নৈমিত্তিক। এখানেই শেষ নয়, বাড়ি থেকে প্রতিটি গ্রামের দূরত্ব চার পাঁচ কিলো এবং প্রতিদিনই গড়ে দু’একটা কল তথা রোগী দেখতে যেতে হত পায়ে হেঁটেই।
মনে পড়ে একদিন বাড়ি থেকে অফিস করে ইচ্ছে হল উপজেলা সদরে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করি। অফিস থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরলাম আরো প্রায় সাত কিলো হেঁটে। ত্বড়িৎ গতিতে হাঁটার অভ্যাস ছিল নিঃসন্দেহে। সকাল থেকে মোট আঠারো কিলোমিটার হেঁটে বাড়ির কাছাকাছি পৌছুতেই বুঝতেছিলাম পায়ের কাফ মাসলে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। ঘরে পৌছেই দেখি আমারই গ্রামের এক খাঁন সাহেব সহ চার কিলোমিটার দূরের দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন তাদের মরণাপন্ন রোগীকে দেখতে যতে হবে। মুমূর্ষু রোগীর তলপেটে হঠাৎ করে টিউমার দেখা দিয়েছে। একদিকে পায়ের সলিয়াস ও গ্র্যাস্টোকনমিয়াস মাংশপেশীর আহাজারি অন্যদিকে পাকস্থলীর অতিরিক্ত প্যারিস্টালসিস তথা ক্ষুধার যন্ত্রণা। এহেন অবস্থায় হাসব না কাঁদব ভেবে উঠতে পারছিলাম না।
শুধু মা বাবা এবং পরিবারের লোকজন কেন, গ্রামের কোন মুরুব্বির কোনরূপ অনুরোধ উপেক্ষা করার মত চক্ষুলজ্জা কখনো ছিল বলে মনে হয় না।
ঝটপট চারটে মুখে দিয়ে যখন রওয়ানা দিলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আঁধার নেমে এসেছে। যাওয়ার তেমন রাস্তাঘাট নেই, বোরো ক্ষেতের আইল এবং বিলের কাঁদা মাড়িয়ে দুর্গম হাওর পাড়ি দিতে হবে পায়ে হেঁটে। বিশাল এলাকাজুড়ে বড় পাশ দেয়া ডাক্তার আর নেই। সুতরাং আমি সবেধন নীলমণি গোবেচারা পেশার খাতিরে, অতঃপর মানবিক কারণে এক ঘন্টার পথ প্রায় সোয়া একঘণ্টায় পৌছলাম। বৃষ্টির দিনে ঘনবসতিপূর্ণ উঠোন বিহীন পাড়ার কর্দমাক্ত চিপা গলি নগ্নপদে অতিক্রম করে মেঝেতে শোয়ানো রোগীকে কুপি বাতির আবছা আলোতে হাটুগেড়ে পরীক্ষা করলাম। তলপেটে কোন টিউমার নয়, প্রস্রাব জমে প্রস্রাবের তলি তথা ইউরিনারি ব্লাডার ফুলে উঠেছে। রোগী যন্ত্রণাায় ছটফট করছে। সাথে থাকা কেথেটার দিয়ে প্রস্রাব নিস্কাশন করার পর মনে হল রোগী যেন স্বর্গসুখ লাভ করল।
রোগীর লোক হাতে একখানা একশত টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন। কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে কুঁড়ে ঘর আর ছেড়া বিছানার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের সকল অনুভূতি এবং অভিব্যক্তিকে চেপে গেলাম। সাথে থাকা লোকজন কিছু আঁচ করতে পারলো কি-না তাও বুঝিনি।
যখন বাড়ি ফিরলাম তখন দুর্গম পথে সারাদিনে আমার প্রায় ছাব্বিশ কিলোমিটার পদব্রজে পরিভ্রমণ শেষ। স্বচ্ছ কসকো গ্লিসারিন সাবান সমেত নাতিশীতোষ্ণ জলের একটা দীর্ঘ প্রশান্তির গোসল অতঃপর বিছানায় গা এলানোর সাথে সাথেই নিদ্রাপরীর ত্বড়িৎ দর্শনলাভ ছিল যেন অন্যরকম এক অনুভূতি।