পাঠকের কলাম...

দিনে দিনে ধর্ষণের মাত্রা সীমাহীনভাবে ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সংবাদ পড়তে হয়। কিছু কিছু সংবাদ পড়ে আমরা শিউরে উঠে যাই। কিছু কিছু সংবাদে আমরা হয়ে যাই হতভম্ব। দুধের বাচ্চারা পর্যন্ত ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি হতে রেহাই পাচ্ছে না। বর্তমানে সব বয়সের নারী ও শিশুরা ধর্ষণের আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে আছে। রাস্তা-ঘাট, যানবাহন, স্কুল-কলেজ, মক্তব-মাদ্রাসা, কর্মস্থল থেকে শুরু করে নিজ গৃহে পর্যন্ত নারী ও শিশুরা নিরাপদ নয়। মহল্লার বখাটে যুবক, নিজ বন্ধু কিংবা সহপাঠী, সহকর্মী, আত্মীয় স্বজন, শিক্ষক, হুজুর, এমনকি নিজ ভাই কিংবা পিতা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হতে দেখা যায়। এতেই বুঝা যাচ্ছে, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের কতোটা অবনতি ঘটেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের কোন নারী ও শিশু নিরাপদ নয়। সবার মনেই অজানা আতঙ্ক, কে যে কবে ধর্ষণের শিকার হবে। পত্রিকা অফিসে একটি ধর্ষণের সংবাদ প্রতিবেদন লিখে শেষ হওয়ার আগেই আরো একটি ধর্ষণের সংবাদ চলে আসে। তবে অধিকাংশ ধর্ষণের সংবাদ চাপা পড়ে যায়। জনমনে একটাই কথা, এভাবে আর কতোদিন চলবে, এর প্রতিকার কোথায়? ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা নিয়েও সুশীল সমাজের অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্য রাখছেন।
বর্তমানে ধর্ষণ একটি জাতীয় সমস্যা এবং এর নিরসন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয়। আমাদের দেশে কিছুদিন পরপর কোনো না কোনো নারী বা শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদে সুশীল সমাজের মানুষ স্বোচ্ছার হয়ে উঠে। কোনো একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলে জনসাধারণের জোরদার আন্দোলন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করা শুরু হয়। অনেকেই রাস্তায় নেমে এসে ওই ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবির পাশাপাশি সব ধরণের নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে সরকারের জোরালো ভূমিকা কামনা করে। তখন ওই ধর্ষণের ঘটনা ও আন্দোলন নিয়ে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সবাই নিউজ কাভারেজে থাকে সরব। সরকার কিছুটা চাপে পড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সাময়িকভাবে ওই নির্যাতনের ঘটনায় কিছু ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওই নির্যাতনের ঘটনার সুষ্ঠু সুরাহা হওয়ার আগেই ধর্ষণজনিত ভিন্ন কোন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে একইভাবে আন্দোলন হয়। আবারো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সরকারের পক্ষ হতে সাময়িকভাবে কিছু ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে চলছে একই দৃশ্যপট, কেবলমাত্র প্রেক্ষাপট গুলো ভিন্ন হয়। জনমনে প্রশ্ন থেকে যায়, এই দৃশ্যপট গুলোর অবসান কোথায়?
বাংলাদেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও তিন হতে চারটি ধর্ষণের মতো ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। তন্মধ্যে অতি অল্প কিছু নির্যাতনের ঘটনায় সীমিত বা বৃহৎ পরিসরে নিয়মিতভাবে আন্দোলন হচ্ছে। তবুও দেশে ধর্ষণের ঘটনা কমছে না, বরং দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে (২০১৪-১৮) ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা এবং ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার হয়েছে প্রায় ৪ হাজার নারী ও শিশু। এই তথ্যটি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও নিজস্ব তদন্ত থেকে আসক হতে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে ১৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, দেশে যে পরিমাণে নারী ও শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সেই তুলনায় মামলার পরিমাণ কম। অনেকেই ঝামেলা মনে করে মামলা দায়ের করতে চায় না। আর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৬ সালে ৪৪৬ জন, ২০১৭ সালে ৫৯৩ জন এবং ২০১৮ সালে ৫৭১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক শিশু।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে যে হারে ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তার অতি নগণ্য পরিমাণ বিভিন্ন তথ্যে উঠে আসছে। প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি ভয়াবহ। অধিকাংশ ধর্ষণজনিত ঘটনা প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়। আবার অনেকেই আছে, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও সামাজিক ভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে এই বিষয়ে মুখ খুলতে চায় না। সর্বোপরি, ধর্ষণের অভিযোগে থানায় মামলা দায়ের করার পর বিভিন্ন আইনি জটিলতা ও হয়রানির কথা চিন্তা করে অনেকেই মামলা করা হতে বিরত থাকে। বিশেষ করে, ধর্ষণের সুরতহাল রিপোর্ট করেন পুরুষ ডাক্তার ও পুলিশ। এটাও অনেকের কাছে গণধর্ষণের মতোই মনে হয়। এছাড়াও মামলা দায়ের করার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে অধিকাংশ ধর্ষিতা। বিশেষ করে পুলিশি নিরাপত্তার অভাব, সমাজপতি ও ধর্ষকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অনেক এগিয়ে যেতে সাহস পায় না। অনেকেই বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করে বিভিন্ন ধরণের হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়, তবুও বিচার পাওয়া যায় না। এইসব অনেক সমস্যার কারণে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা মাটি চাপা পড়ে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মতে, ধর্ষণের মতো অপরাধ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ঘুষ গ্রহণ করে। ধর্ষিতাকে সহযোগিতার পরিবর্তে উল্টো বিভিন্নভাবে হয়রানি করে। আবার অনেক পুলিশ আছে, মামলা পর্যন্ত নিতে চায় না। তাদের কারণে বিভিন্নভাবে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেও ধর্ষক পার পেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ভারতের চেয়েও শক্তিশালী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তবে সে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় উল্লেখ আছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে এবং পাশাপাশি সর্বনিম্ন ১ লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমন একটি কঠিন আইন থাকা সত্ত্বেও এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। যার কারণে আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা সীমা ছাড়িয়ে মহামারি আকার ধারণ করেছে।
জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্নভাবে ধর্ষণ মামলার আসামি জামিন পেয়ে যায়। টাকা পয়সা খরচ করে কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধর্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। একটি গণমাধ্যমে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা জেলার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৪টি। এসময় মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি। সাজা হয়েছিল ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ বিচার হয়েছিল ৩ শতাংশের কম। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস পেয়ে গেছে। নারীপক্ষের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে করা তিন হাজার ৬৭১টি মামলায় মাত্র চারজনের সাজা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি আর অদক্ষতার কারণে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। অনেক সময় আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশের গাফিলতি থাকে। অনেক সময় টাকা খেয়ে মামলা ঘুরিয়ে দেয়ার অনেক ঘটনাও রয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সর্বস্তরের মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে স্বোচ্ছার হয়ে প্রতিবাদ করে। সামাজিকভাবে ধর্ষণের মতো অপরাধ অতি ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ হতে বিভিন্ন সময়ে অনেক ইতিবাচক বিবৃতি পাওয়া যায়। তবুও আশাহত হতে হয়, দিনে দিনে লাগামহীন ভাবে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। আর আইনের চোখে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে সমাজের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে করে জনমনে প্রশ্ন উঠে, ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকার আসলেই কতোটা আন্তরিক? তাই আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার এই বিষয়ে আরো অধিক কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। প্রতিটি ধর্ষণের মতো ঘটনায় দলমত নির্বিশেষে দেশের প্রচলিত আইনে প্রত্যেক ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা নিবে। আইন-শৃৃৃৃঙ্খলা বাহিনীকে ধর্ষকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দিতে হবে এবং তাদের কাজের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোন ধর্ষক যেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় রক্ষা না পায়। প্রত্যেক ধর্ষকের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে ধর্ষণের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাবে। সর্বোপরি, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং সেটা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক ঃ সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সম্পাদক, ত্রৈমাসিক আমাদের গল্পকথা
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা।
মোবাইলঃ ০১৭১৯২৮২৭১২
স্থায়ী ঠিকানা: পশ্চিম ভাদৈ, হবিগঞ্জ।