ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
শরতের শেষ বিকেলে বাংলার অপরূপ রূপসৌন্দর্য্য তুলনাবিহীন। নদীতীরে কাঁশফুল, আকাশে ভাসমান শ্বেতশুভ্র ও সোনালী গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের ভেলা, প্রশস্ত নদীতে চলমান রঙ বেরঙের পাল তোলা নৌকা, মাঝির সুমধুর সুরে ভাটিয়ালি, এ যে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির অপূর্ব এক মহামিলন। চাচা জানালেন আমদের অবস্থান এখন ভৈরব ও গন্তব্যস্থল মদনগঞ্জের মধ্যবর্তীস্থানে অর্থাৎ বাড়ি থেকে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পথ চলে এসেছি। তখনো সন্ধ্যার প্রায় আধা ঘণ্টা বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্দিষ্ট কোন খাড়িতে নোঙর করতে হবে। পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া সূর্যের লাল আভার ঘনত্ব ক্রমশঃ বর্ধমান। আকাশে পাখির ঝাকের ঘরে ফেরা ও কলকাকলির অনুরণন মন মননে অন্য মাত্রার এক শিহরণ তুলছিল। বেলাশেষে খেলা শেষ করে দূরন্ত কিশোরদের নদীতে নেমে ঝাপাঝাপি দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন আমার কাছে এখন হারিয়ে যাওয়া সদ্য এক সোনালি অতীত। ডান তীরে ছায়া সুনিবিড় যেন শান্তির নীড় মস্ত এক গ্রাম। রাখাল তাদের গরুপাল নিয়ে ঘরে ফেরা শুরু করেছে। গোধূলি বেলার (সন্ধ্যা বেলায় ঘরে ফেরা গরুর পায়ের আঘাতে উড়ন্ত ধূলি) এমন অপরূপ সৌন্দর্যের বিবরণ বাংলা সাহিত্যের বিরাট অংশ দখল করে আছে বৈ কি।
পাল নামিয়ে ফেলা হল। চাচা ডানদিকে একটা বড় বাজারের নিকটে বড় এক খাড়িতে নৌকা ভিড়াতে বললেন। আরো অনেক নৌকা ভিড়তে লাগল। মনে হল যেন ভিন্ দেশি বিভিন্ন আকার ও রঙের ছোটবড় অনেক নৌকার এক মিলন মেলা। চতুর্পার্শ্বের পাল নামানোর গড়গড় শব্দ জানান দিচ্ছিল সন্ধ্যা সমাগত। কিছুটা দূরের মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের সুমধুর আযানের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। প্রতিটি নৌকায় হারিকেনের আলো মিটমিট করে জ্বলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর এক পাড়া থেকে উলুধ্বনি ও কাসার বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল যা অবশ্যই ছিল নামাজ শেষ হওয়ার পর। বুঝা গেল হেথায় বহমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যথার্থই বিদ্যমান যুগ যুগ ধরে।
চাচা হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন গেল দু’দিন শুকনার সাথে সম্পর্কহীন আমি অনেকটা শ্বাসকষ্টের রোগীর অক্সিজেন স্বল্পতার মতই ভুগছি। তাই আমাকে নিয়ে বের হওয়া উচিৎ। এখানে বিশেষ করে নৌকার লোকজনদের উপলক্ষ করেই সান্ধ্যকালীন বাজার বসে। চাচা দরছভাই ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে গেলেন। বিরাট মাছের বাজার, অনেক রকমের ছোটবড় মাছের আমদানি। চাচা মাঝারি একটা রুইমাছ, কিছু টাকামাছ (এখন বিলুপ্তপ্রায়), মাংশ ও সব্জি কিনলেন। নৌকায় ফেরার পথে একটা দোকানের বাহিরে ব্রেঞ্চে বসে চাচা ও দরছভাই চা খেলেন, আমাকে আধা গ্লাস খাঁটি দুধের হলদেটে সর দিতে বললেন।
জোৎস্নারাতে সবাই নৌকার ছইয়ের উপরে বসে আড্ডায় মেতে উঠলেন। নির্দ্বিধায় এক নৌকার লোক অন্য নৌকায় ঘুরে ঘুরে গল্পগুজব করতে লাগলেন। জানা নেই শোনা নেই অথচ মনে হল কত আপন, কত পরিচিত, কি যে এক বন্ধন! আর আজ শহুরেজীবনে একই অট্টালিকায় অনেক পরিবারের অনেকদিন যাবৎ বসবাস থাকলেও নেই তেমন কোন যোগাযোগ, নেই নির্ভেজাল তেমন কোন আন্তরিকতা। সত্যি এখানে আজ ‘ইটের উপরে ইট, তার ভিতরে মানুষ কিট’। এখানে ‘ইটের পাজরে লোহার গাথায় দারুণ মর্ম ব্যথা’। এখানে আছে দেয়ালঘেরা ছাদ, নেই খোলা আকাশ; আছে শত ওয়াটের ঝলমলে আলো, নেই হৃদয় জুড়ানো সেই চাঁদনি (জোৎস্নার আলো); আছে এসির ঠান্ডা পরশ কিন্তু নেই মৃদু বহমান অম্লজান সমৃদ্ধ সেই শীতল হাওয়া। এখানে আছে দেহ নেই তাতে প্রাণ, আছে মন নেই মানবিকতা, আছে অন্তর নেই আন্তরিকতার তেমন কোন ছোঁয়া।
রকমমামু একটুপর খেতে ডাকলেন। আটজন একসাথে গোল হয়ে খেতে বসলাম বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারের সকলকে নিয়ে খাওয়ার চিরাচরিত নিয়মের মতই, যে খাওয়াতে নেই হিসেব কিতেব, নেই কোন সংকোচ। যার যতটুকু ইচ্ছে খোশগল্পের ভিতর দিয়েই খেয়ে যাচ্ছিলেন তৃপ্তি সহকারে। চাচা আমার পাতে রুইমাছের আস্ত মাথাটা তুলে দিলেন। সবারই আমার প্রতি কেমন যেন এক বিশেষ নজর। সত্যি আহারান্তে তৃপ্তির ঢেকুরের চেয়েও তাদের আন্তরিকতাপূর্ণ আপ্যায়নটা ছিল আরো অনেক ভাল লাগার, আরো অনেক মনে রাখার।
চলবে…