ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
ভাসমান বর্ষায় দূর থেকে তখনকার সময়েই প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাকা ঘরবাড়ির পানিতে প্রতিফলন বা প্রতিসরণ ছিল দারুণ ॥ একটা ব্যাপারে দারুণ মজা পেলাম, যদি ঘাটলায় কোন গর্ভবতী মহিলা থাকেন দূর থেকে ইঙ্গিত দেয়ার সাথে সাথে নৌকার গুণের রশি মাটিতে ফেলে দিতে হবে, তাদের মাথার উপর দিয়ে নেয়া যাবে না। এর মাহাত্ম্য আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনি
সাথে আনা মানচিত্রের বইটা দারুণ কাজে লেগেছিল। ভৈরবের নিকটে এসে নৌকায় বসে বাম দিকের আশুগঞ্জ নদীবন্দর ও ডান দিকের ভৈরব বাজার উপভোগ করছিলাম। আশুগঞ্জ হল তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা তথা বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার অন্তর্ভুক্ত আর ভৈরব ছিল কিশোরগঞ্জ মহকুমা অর্থাৎ বৃহত্তর ময়মনসিংহের আওতাধীন। শুধু নদীতীরবর্তী নয় কিছুটা দূরদূরান্তের বিভিন্ন শহরবন্দরের অবস্থানও যখন চাচাকে দেখাচ্ছিলাম বড় চাচা খুব মজা পাচ্ছিলেন। আজ কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ভৈরব চলে আসি, হয়ত উজানভাটিতে হাল্কা চা-নাস্তা। কিন্তু যাযাবরের মতই বলতে হয়, ‘এতে আছে আনন্দ, নেই উপভোগ। যা অনেকটা কমলালেবুর পরিবর্তে ভিটামিন সি ট্যাবলেট খাওয়ার মতোই’। চাচা উনার ব্যবসার প্রয়োজনে অনেক নদীবন্দর ঘুরেছেন। তাই পূর্বেও আমি যখন বই খুলে নদ নদীর গতিপথ, শহর বন্দরের অবস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতাম খুব মজা পেতেন। সুতরাং এসময়েও দারুণ আনন্দই ভোগ করছিলেন। আগের দিনেও হাওরের চতুর্দিকের বিভিন্ন গ্রাম, নদীতীরের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাতলপাড়, কিশোরগঞ্জের বাঙ্গালপাড়া, হুমায়ূনপুর, উল্লেখযোগ্য বাজার, লঞ্চ স্টেশনগুলি দেখাচ্ছিলেন। শায়েস্তাগঞ্জের দাদার নিকট থেকে বাঙ্গালপাড়ার ঢাকাতে অবস্থানরত বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডা. কেফায়েত উল্লাহ সাহেবের নাম শুনতাম। হূমায়ূনপুর হল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খাঁন সাহেবের বাড়ি। ভাসমান বর্ষায় দূর থেকে তখনকার সময়েই এমনতর প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাকা ঘরবাড়ির পানিতে প্রতিফলন বা প্রতিসরণ ছিল দারুণ!
দূর থেকে ব্রীজের উপর দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময়ে পানির উপর দিয়ে ভেসে আসা হুইসেল ও গড়গড় শব্দটাও ছিল উপভোগ্য বিশেষ করে কয়লার ইঞ্জিনের। মনে হচ্ছিল যেন বিভুতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ে ‘পথের পাচালী’র ঐ কয়লার ইঞ্জিনেরই হুইসেল শুনছি। পুলের নীচ দিয়ে যাওয়ার সময়ে উল্টোদিক থেকে আসা বিভিন্ন রঙের পালের নৌকা, লঞ্চ, মালবাহি কার্গোর দৃশ্যটাও কম উপভোগ্য ছিল না।
বাতাসের গতিবেগ উল্টোদিক থেকে হওয়ায় সবাই দাড় টানছিলেন। চাচা চলতি নৌকা থেকেই মাছ কিনলেন। বড় অথচ টাটকা রূপালি ইলিশের গায়ে সকালের রোদের ঝলকানি মনে হচ্ছে চোখ সম্মুখে আজো চিকচিক করছে। মাঝারি আকারের ডিমওয়ালা চিংড়ি মাছও কিনলেন। রায়পুরার সায়দাবাদ, বেগনাবাজ পৌঁছার পর চারজন দাড়টানা ছেড়ে গুণ টানতে নেমে পড়লেন নদীর ডান তীরে। চাচা হাল ধরলেন, একজন গলুইতে বসে সামনদিকে নজর রাখছিলেন যাতে অন্য নৌকার সাথে কোন সংঘর্ষ না হয়। উল্টোদিক থেকে আসা গুণটানা নৌকাগুলো কোনটা ভিতর দিয়ে, কোনটা বাহির দিয়ে যাবে তা নির্ভর করে মাস্তুলের উচ্চতার উপর। নৌকার দিকের রশি বাঁধতে হয় মাস্তুলের ডগায় আর তীরের দিকে আরো কয়কটা রশি প্রধান রশি থেকে সমান্তরালভাবে টেনে বাকি তিনজনের টানার সিস্টেম করে নিতে হয়। উল্টোদিকের নৌকা ক্রস করার সময় কাঁধের গুণের রশি পানিতে ফেলে দিতে হবে, কা’দের নৌকা ছেড়ে দেয়া রশির উপর দিয়ে যাবে এটারও একটা নিয়ম আছে। গুণ লাগানোর ফলে নৌকার গতিবেগ বেড়ে গেল অনেক। নৌকা চলার গতি নিয়ে কথায়ই আছে ‘বৈঠায় অর্ধেক, ছইরে (নৌকা বাওয়ার জন্য চিকন লম্বা মাকাল বাঁশ) একগুণ, গুণে দ্বিগুণ আর পালে চারগুণ’।
শরৎ রচনাবলী পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এসব দৃশ্য অবলোকন ও উপভোগ করছিলাম। চাচা নানাবিধ কৌতুুহলী প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। দু’তিন কিলো দূরে দূরের প্রতিটি গ্রামেই কয়কটা ঢালু কাদাহীন বালুময় ঘাটলা থাকে। ছোটবড় নারী পুরুষ সকলের দলবেঁধে একসাথে গোসলের দৃশ্য ছিল অনন্য। মা চাচিরা বাচ্চাদের জোর করে ধরে সাবান মেখে ঢলে দেয়া, কিশোরদের পানিতে হৈ চৈ করে জলকেলি, সাতরানো, লাই খেলাও ছিল উপভোগ্য। একটা ব্যাপারে দারুণ মজা পেলাম যে, যদি ঘাটলায় কোন গর্ভবতী মহিলা থাকেন দূর থেকে ইঙ্গিত দেয়ার সাথে সাথে গুণের রশি মাটিতে ফেলে দিতে হবে, তাদের মাথার উপর দিয়ে নেয়া যাবে না। কোন পুরুষলোক থাকলে উনারা চিৎকার শুরু করেন। মহিলা রশির উপর দিয়ে ক্রস করে যাওয়ার পর আবার গুণটানা শুরু হয়। চাচা বললেন যদি ভুলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ রশি মাটিতে না ফেলে তখন জটলা বেঁধে গন্ডগোল শুরু হয়ে যায়, এমনকি এ নিয়ে মাঝেমধ্যে আচার বিচারও করতে হয়। এর মাহাত্ম্য আমি আজো বুঝে উঠতে পারিনি।
গোসলের সময় হলে চলতি নৌকা থেকেই পানিতে নামতে প্রস্তত হলাম। রকম আলী মামু বাঁধা দিলেন। এখন সবেমাত্র জোয়ার এসেছে। নেমে ধাপাধাপি করলে শরীর ব্যথা করবে। কে শুনে কার কথা। নৌকার গলুই থেকে ঝাপ দিয়ে পড়ে পাছার বৈঠা বেয়ে বেয়ে উঠে বারবার ঝাপ দিতে থাকলাম। চাচা সামনদিকে নৌকার একটা গোড়াতে রশি বেঁধে দিলেন। স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে চলতি নৌকায় পানিতে ঝুলে থেকে বিনা পরিশ্রমে সাঁতার কি যে মজা! দুপুরের খাবার সময় হলে সবাই নৌকায় চলে আসলেন। বামদিকের দাউদকান্দি থানার মরিচাকান্দি বাজারের বরাবর আসলে ভাটার অনুকূলে নৌকা ছেড়ে দিয়ে একসঙ্গে সবাই খেতে বসলাম। খাওয়ার মাঝেই ত্রিশ চল্লিশ মিনিটে নৌকা আপনাআপনি অনেকদূর এগিয়ে গেল। টাটকা ইলিশের সুস্বাদু ভাজি ও চিংড়ি ভুনার অনন্য ঐ স্বাদ অদ্যাবধি জিহ্বার টেস্টবাড আর কখনো স্পর্শলাভ করেছে কিনা আমার জানা নেই।
ঐদিন রাত্রে শুয়ার সময় সারা গা মেজমেজ করছিল, তা পানিতে অধিক্ষণ ডুবাডুবির ফলে নাকি চন্দ্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে জোয়ারের কারণে তা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি।
চলবে….