তদন্তে আসছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে বানিয়াচঙ্গের মুরাদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আকাদ্দছ হোসেন তালুকদারসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ অভিযোগ দায়ের করেন নীল হোসেনপুর প্রকাশ বিথঙ্গল গ্রামের মৃত যতীন্দ্র রায়ের কন্যা কল্পনা রায়। মামলার অন্য দুই অভিযুক্ত হলেন- মুরাদপুর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের আব্দুল আলী (৭৬) ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার রসুলপুর গ্রামের মৃত আমজাদ আলীর ছেলে মোঃ আশরাফ উদ্দিন (৬৮)।
অভিযোগটি শীঘ্রই তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তা আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, অভিযোগটি তদন্তের জন্য ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম শীঘ্রই হবিগঞ্জ আসবে। এই টিমের নেতৃত্বে থাকবেন সহকারী পুলিশ সুপার শাহজাহান কবির। তদন্তপূর্বক অভিযোগের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অভিযোগে কল্পনা রায় উল্লেখ করেন ১৯৯১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার নিজ থানা বানিয়াচং ও পাশ্ববর্তী আজমিরীগঞ্জে পাকিস্তানী সেনাদের শক্তিশালী ক্যাম্প ছিল। বানিয়াচং থানা ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন বিথঙ্গলের সুলতান মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যরা। অপরদিকে বানিয়াচংয়ের কুখ্যাত রাজাকার ফজলুল হক ওরফে মুতওয়াল্লির এবং আজমিরীগঞ্জের প্রধান রাজাকার সিরাজ ও দুলা মিয়ার সাথে সুলতান মিয়া ও তার ছেলেদের সু-সম্পর্ক ছিল। এই সুবাদে সুলতান মিয়ার বাড়িতে রাজাকাররা নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো। সুলতান মিয়ার ছেলেদের নেতৃত্বে তার নিজ বাড়িতে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। ওই ক্যাম্পে রাজাকারদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলতো। সুলতান মিয়ার ছেলে যুদ্ধাপরাধ মামলায় কারাগারে আটক মধু মিয়ার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয়েছিল মধু বাহিনী। এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মধু মিয়া। অভিযোগকারী কল্পনা রায়ের পিতার সাথে সু-সম্পর্ক ছিল তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রমেশ পান্ডের। যুদ্ধকালীন সময় তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা খলিল মিয়াসহ ১০/১২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তাদের বাড়িতে এসেছিলেন রমেশ পান্ডে। তখন অভিযোগকারী কল্পনা রায়ের বয়স ছিল ১৩/১৪ বছর। ১৮ অক্টোবর প্রথম রমজানের রাতে রমেশ পান্ডের দল এবং জগত জ্যোতির দাস পার্টি মিলে আক্রমণ করে পাকিস্তান আর্মির শক্তিশালী ঘাটি বানিয়াচং থানায়। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধারা আজমিরীগঞ্জের রাজাকারদের ঘাটি উড়িয়ে দেয়। এরপর থেকে বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জের কিছু রাজাকার সুলতান মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। এর মধ্যে আশরাফ উদ্দিন বাহেরচর গ্রামের খুরশিদ মিয়া, আব্দুল আলীসহ আরো কয়েকজন রাজাকার ছিল।
অভিযোগে কল্পনা রায় আরো বলেন- ওই সময় আমাদের গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় রাজাকার মধু বাহিনীসহ বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে রাজাকাররা বিথঙ্গল গ্রামে আশ্রয় নিয়ে নির্বিঘেœ তাদের মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড চালিয়ে যায়। ২৬ নভেম্বর মধু মিয়ার আপন ছোট ভাই আকাদ্দছ হোসেন তালুকদার ও আশরাফ উদ্দিন এবং আব্দুল আলীসহ ৪/৫ জন সশস্ত্র রাজাকার আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। এ সময়া তারা আমার বাবাকে হাত ও চোখ বেধে টেনে হেছড়ে ঘরের বাহিরে নিয়ে যায়। এরপর ওই ৩ রাজাকারসহ আরো কয়েকজন রাজাকার আমাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারালে রাজাকাররা আমাকে একটি শ্মশানে ফেলে রেখে চলে যায়। পরবর্তীতে আমার জ্ঞান ফিরলে আমি দেখি শ্মশানে পড়ে আছি। তখন আমার উঠে বসার শক্তিও ছিল না। এ অবস্থায় ২ জন লোক আমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করান এবং হবিগঞ্জ শহরে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় পৌছে দেন। এর মধ্যে আমাদের ভিটে মাটি ছেড়ে মা’সহ পরিবারের সদস্যরা হবিগঞ্জে চলে আসেন। কিন্তু আমার অপহৃত বাবার কোন সন্ধান না পেয়ে আমার মা পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন। বাবার নিখোঁজের পর পরিবারের উপার্জনের কোন লোক না থাকায় আমাদের অনাহারে অর্ধাহারে জীবন চালাতে হয়েছে। এর মধ্যে আমার মা কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আমরা তার কোন খোঁজ সন্ধান পাইনি। সারাজীবন পেটের দায়ে অন্যের বাসায় ঝি এর কাজ করে কাটিয়েছি। শেষ বেলায় এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের নিকট বিচার প্রার্থনা করি। গত ২৮ মার্চ কল্পনা রায় ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রার্থী হন।
অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য সাবেক চেয়ারম্যান আকাদ্দছ হোসেন তালুকদার এর সাথে মোবাইল ফোনে (০১৭১১৫৭৪৩৭৬) যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।