জীবনের প্রথম বিদেশ সফর থাইল্যান্ড এই নিয়ে নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ঠাট্টা তামাশা করলেন
জালাল আহমেদ
আমি চাকুরির শুরু থেকেই মাঠ প্রশাসনে কাজ করছিলাম। মাঝে একবার ১৯৮৮ সালে ঢাকায় ভূমি মন্ত্রণালয়ে পদায়ন হয় সহকারী সচিব পদে, সিনিয়র স্কেল আদেশ হলেই স্কেল পাবো এই প্রত্যাশায় আমি যেতে চাইছিলাম। জেলা প্রশাসক চাঁদপুর আমাকে না যেতে উদ্বুদ্ধ করলেন কারণ তিনিও ছিলেন মাঠ প্রশাসনের অফিসার। ১৯৭০ এর ব্যাচ, ঢাকায় প্রথম এসেছেন ১৯৮৯ সনে। আমাদের সময়ে মাঠ প্রশাসন থেকে বিদেশে যাবার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। এ কারনে ১৯৯৬ পর্যন্ত, চাকুরির ১৩ বছর পরেও আমি দেশের বাইরে যাবার কোন সুযোগ পাইনি। ১৯৯৭ এর শুরুতে আমাকে থাইল্যান্ডের প্রিন্স শনখলা ইউনিভার্সিটিতে তিন সপ্তাহের একটি কোর্সে মনোনয়ন দেয়া হয়। মনোনয়নের চাহিদা অনুযায়ী ঢাকায় এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে কাগজাপত্র থাইল্যান্ডে প্রেরণ করতে হবে চূড়ান্ত মনোনয়নের জন্য। আমার পাসপোর্ট করা ছিল না। নোয়াখালী জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয় কিন্তু তা কেবল ইন্ডিয়া’র জন্য। এদিকে আমার একদিনের মধ্যেই পাসপোর্ট লাগবে কাগজপত্র চূড়ান্ত করার জন্য। নোয়াখালী কালেক্টরেটের সহকারী কমিশনার আবদুল মতিন পাসপোর্ট অফিসার ছিলেন। তিনি ভোরের বাসে কুমিল্লা চলে গেলেন এবং কুমিল্লা থেকে আমার প্রথম আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট বিকেলের মধ্যে সংগ্রহ করে রাতে আমাকে বিয়ামে পৌঁছে দিলেন।
জীবনের প্রথম বিদেশ সফর থাইল্যান্ড এই নিয়ে নোয়াখালীর সিভিল সার্জন ঠাট্টা তামাশাও করলেন। কিন্তু চূড়ান্ত মনোনয়নের চিঠি পেলাম কোর্স শুরুর পরদিন। আমার পরবর্তী অভিজ্ঞতায় দেখেছি এমন কোর্সে দুই তিনদিন পরে যোগদান অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তখনতো আর সেই অভিজ্ঞতা নাই, নিজের সিদ্ধান্তেই জীবনের প্রথম হতে পারতো এমন বিদেশ যাওয়া বাদ দিলাম! তবে দেশটি থাইল্যান্ড না হলে হয়তো বাদ দিতাম না। ১৯৯৭ সালেই সিডিএসপি প্রকল্প থেকে দু’টি দলের বিদেশ সফরে যাবার কথা জানিয়ে টিম লিডার আরেন্ড ভ্যান রেইজেন ২৩ এপ্রিল একটি পত্র দিলেন। যাবার তারিখ একদম কাছে, ২১ মে ১৯৯৭, কনিষ্ঠ দল থাইল্যান্ড এবং সিনিয়র দল দ্য নেদারল্যান্ডস যাবে। আমি তখন এডিসি (সার্বিক) কিন্তু সিডিএসপি প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক। প্রকল্প অফিস আমাকে নিবে কিন্তু সঙ্গত কারণেই এডিসি (রাজস্ব) ভাবলেন এটা তাঁর অধিকার। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিল যে প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তাই যাবেন। সমস্যা বাঁধালেন আমার জেলা প্রশাসক, তিনিও যাবেন।
উন্নয়ন সহযোগীদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজী করানো হল কারণ তারা আমাকে বাদ দিয়ে জেলা প্রশাসককে নিবেন না। ফলে আমাদের উভয়কে নিয়ে ১২ জনের দল গঠন হল। শুরুতে কোন দলনেতা না থাকলেও চূড়ান্ত ১৪ জনের দলে দলনেতা হলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দুলাল আবদুল হাফিজ। তিনি ছিলেন ১৯৭৭ ব্যাচের হিসাব ও নিরীক্ষা ক্যাডার থেকে আসা উপসচিব। একজন নিপাট ভদ্রলোক যদিও ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে বিনা কারণে সামান্য ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল।
প্রকল্পের আমাদের অংশ ভূমি মন্ত্রণালয়ের তাই আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করলাম অনুমতির জন্য। আমি সংশ্লিষ্ট ডেস্ক অফিসার আরফিন আরা বেগম অনুরোধ করলাম জেলা প্রশাসক ও আমার সরকারি আদেশ করে দেবার জন্য। আমার চাকুরির ১৩ বছর আমি মাঠ প্রশাসনে, তখনো বিদেশে যাই নাই, বিদেশ যাবার সরকারি আদেশ কে করবে সে ধারণাও ছিল না। আরফিন আরা, যার সংগে পরে অর্থ বিভাগে কাজ করেছি, তিনি যথাযথ অনুমোদন নিয়ে আদেশ একটা করে ফেললেন। ভূমি মন্ত্রণালয় সরকারি আদেশ করে ফেলার পর জানা গেল যে এই আদেশ ভূমি মন্ত্রণালয় করতে পারবে না, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় করবে। আমাদের আদেশ আগে হবার পরেও আমরা পিছিয়ে গেলাম।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগ তাঁদের কর্মকর্তাদের আদেশ করে ফেললো। আমাদের যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে আর আমাদের নথি ধীরে সুস্থে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়ে। দু’দিন পর ফ্লাইট এই অবস্থায় আমি ঢাকায় এলাম এবং নথি অনুসরণ করে গেলাম প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়ে। তখন পর্যন্ত মফঃস্বলে চাকুরি করা আমি ঢাকা’র পথঘাট ভালো চিনি না। কিন্তু অনেকেই আমাকে চেনেন বা নাম জানেন, এতে একটু বাড়তি সুবিধা পেয়ে গেলাম। প্রধানমন্ত্রী’র প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ (নাসিম) এক সময়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রটোকল অফিসার ছিল। ফেনীর সন্তান নাসিম ছাত্র জীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতিও ছিল।
আমি প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়ে নাসিমের রুমে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বসে থাকলাম। সে ফাইল সংগ্রহ করে নোট লিখিয়ে সকল ধাপ পার করে তা’ গণভবনে পাঠালো। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দপ্তরের কাজ শেষ করে নামাজ ও লাঞ্চের জন্য ভেতরে। নাসিম ফোন করে সহকারী একান্ত সচিব ইব্রাহীম হোসেন খানকে এমনভাবে তাগিদ দিলেন যে ইব্রাহীম হোসেন খান নথি হাতে নিয়ে ভেতর থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিজে এই ফাইল প্রধানমন্ত্রী’র দপ্তরে ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন এবং নাসিমের রুমে উঁকি দিয়ে নাসিম ও আমাকে বলে গেলেন। এরপর আবার শুরু হল “মিস্ট্রি অব মিসিং ফাইল”! ফাইল হারিয়ে গেল, ফাইল আর পাওয়া যায় না। নাসিম তাঁর লাঞ্চ বাদ দিল এই ফাইলের অনুসন্ধানে। বিকেল চারটার পর যখন ফাইল পাওয়া গেল তখন আমি নাসিমকে বললাম যে এই ফাইল ফটোকপি করে আমাকে দাও আর মূল ফাইল পাঠিয়ে দাও। নাসিম তাই করলো।
রাতে বিয়ামে ঘুমিয়ে সকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-৩ শাখায় যাই। শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাই, প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাই এমনকি টাইপিস্টও নাই। আমি নিজে বসে খসড়া করলাম, অন্য একজনের সহায়তা নিয়ে টাইপ করালাম। ভিন্ন শাখার কর্মকর্তাকে দিয়ে চিঠি স্বাক্ষরও করালাম। অবশেষে সরকারি আদেশ হাতে পেলাম। জেলা প্রশাসক নোয়াখালীকে ফোন করে জানালাম। আদেশ হাতে নিয়ে জনপ্রশাসনের বিখ্যাত দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামবো তখন শুনি কেউ একজন এডিসি নোয়াখালীকে খুঁজছে, জোরে জোরে, ডাক ছেড়ে। আমিতো আর কারণ জানি না, বুঝতেও পারলাম না যে এডিসি নোয়াখালী কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। জবাব দিলাম, বললো যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাকে খুঁজছেন। আমি অবাক কারণ আমি আসলেই এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ না! চারতলায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের রুমে গিয়ে দেখা করলাম, তিনি বললেন যে এক্ষুনি নোয়াখালীতে ফিরে যাও!