বাংলাদেশে বৃহত্তম খাল খনন প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ
জালাল আহমেদ

নিয়মানুসারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণ বিভিন্ন স্কুল কলেজের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি’র সভাপতিত্ব করতেন। অন্য আরো প্রতিষ্ঠানের সংগে আমি সুলতানপুর স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডি’রও সভাপতি ছিলাম। প্রতিষ্ঠানের একটি মিটিং এ গিয়ে পরিচয় হয় এর অন্যতম দাতা সদস্য হানিফ ভূঁইয়া’র সংগে। তিনি ছিলেন তৈরী পোষাক প্রস্তুতকারক বড় প্রতিষ্ঠান আবেদিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। ঐ সময়ে তিনি এক কোটি আটত্রিশ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ঐ স্কুল-কলেজের একটি ভবন তৈরি করে দিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে উদ্যোক্তা হবার আগে তিনি বাংলাদেশ বিমানে চাকুরী করতেন বলে শুনেছি। প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি সভা করার পর হানিফ ভূঁইয়া’র সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায়। তিনি অত্যন্ত অমায়িক এবং ভদ্রলোক ছিলেন। একবার ঢাকায় এলে তিনি আমাকে তাঁর অফিসে আমন্ত্রণ জানান এবং আমি সেখানে যাই।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রেমিটেন্স ড্রিভেন এবং এক্সপোর্ট ড্রিভেন বলা হয়। বর্তমানে কোভিড অতিমারীতে আক্রান্ত বিশ্বেও বাংলাদেশের রেমিটেন্স ক্রমবর্ধমান এবং রপ্তানী আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি। বাংলাদেশের রপ্তানী আয়ে গত ২০ বছরে তৈরি পোষাক খাতের অংশ ৭৫-৮৪%। তৈরী পোষাক খাতের বয়স ৪২ বছর আর এই খাতের প্রায় সকল উদ্যোক্তার উত্থানও এ সময়ের মধ্যে। তারমধ্যে অনেকেই শূন্য থেকে শুরু করে বর্তমানে পোষাকখাতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অকালপ্রয়াত হানিফ ভূঁইয়াও ছিলেন তাঁদেরই একজন। আমাকে তিনি বললেন যে তিনি প্রায় প্রতিদিন সকাল ৬টায় কাজ শুরু করেন কারণ তখন তাঁর হংকং অফিস খোলে। আর সারাদিন কাজ করার পর রাত পর্যন্তও অফিসে থাকেন এবং নিউইয়র্ক অফিস খোলার পর তাদের সংগে কোন কাজ থাকলে তা শেষ করে ঘরে ফিরেন। অর্থাৎ তৈরি পোষাকখাতের উদ্যোক্তাদের এই সকাল ৬টা – রাত ৮টা’র টাইমফ্রেম সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা নাই। আমি এখন যার সংগে কাজ করি তিনি বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানীকারক, এই খাতে তাঁর ব্যবসা ৩৫ বছর কিন্তু এখনো তিনি সকাল ৮টা – রাত ৮টা রুটিনে কাজ করেন।
চৌমূহনী চৌরাস্তায় একটি বেসরকারি বিদ্যালয় ছিল যার নাম নোয়াখালী পাবলিক স্কুল। ১৯৬৫ ব্যাচের প্রথিতযশা সিএসপি কোম্পানীগঞ্জের মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা এবং তখন এর পরিচালনা কমিটির সভাপতি। স্কুলের বেশ কিছু সমস্যা ছিল এবং আমরা তা নিয়ে বিব্রতও ছিলাম। স্যার আসলে এর মিটিং এ উপস্থিতি ছাড়াও আমি তাঁকে সংগ দিতাম কারণ মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ ছিলেন সিলেটের কিংবদন্তী জেলা প্রশাসক। তখন আমি কলেজে পড়ি, ১৯৭৭-৭৮, হবিগঞ্জে এসডিও ছিলেন মোঃ আজিজুর রহমান (পরে সংস্কৃতি সচিব), জেলা প্রশাসক সিলেট মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ এবং কমিশনার ছিলেন কোম্পানীগঞ্জের আরেকজন সিএসপি মোঃ আবদুল আওয়াল। তখন দেশে জিয়াউর রহমানের খালকাটা বিপ্লবের যুগ। ডঃ মহিউদ্দিন খান আলমগীর জেলা প্রশাসক যশোর। তিনি সেখানে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে উলশী-যদুনাথপুর খাল খনন করে ও মিডিয়া ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচারণার কারণে সারাদেশে পরিচিত হন এবং পরবর্তীতে তিনি পিএইচডি ও করেন এই বিষয়ে।
একই সময়ে হবিগঞ্জে ‘খোয়াই নদীর বাঁক পরিবর্তন’ প্রকল্প গ্রহণ করে তা কেটে নদীকে শহর থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়। অপসারিত মাটির পরিমাণ বিবেচনায় তৎকালীন বাংলাদেশে বৃহত্তম খাল খনন প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ। কিন্তু তৎকালীন জেলা সদরের নিকটে না হওয়ায় এর প্রচার ছিল কম আর তিনি হয়তো মিডিয়া ব্যবহারে অত আগ্রহীও ছিলেন না। হবিগঞ্জ শহরের বর্তমান পূর্বমুখী সম্প্রসারণের জন্য তাঁর এই অবদান অবিস্মরণীয়। সিলেটের মানুষ ফয়েজউল্লাহকে এখনো মনে করে ১৯৭৭-৭৮ সালে সিলেট শহরের সড়ক সম্প্রসারণে তাঁর সাহসী উচ্ছেদ অভিযানের কারণে। কোন বাঁধা বা প্রতিরোধই তাঁকে ঠেকাতে পারেনি রাস্তা সম্প্রসারণের এই উদ্যোগ থেকে। এখনকার সিলেট শহরের রাস্তাঘাটের যে রূপ তাঁর রুপকার মোহাম্মদ ফয়েজউল্লাহ। তাঁর সম্পর্কে প্রচুর গল্প-গাঁথা সিলেটে প্রচলিত। তবে তাঁর নিজ জেলা নোয়াখালী থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোককে সিলেটের খাস জমিতে পুনর্বাসনের জন্য তাঁর সমালোচনাও করা হয়।
ফয়েজ উল্লাহ স্যার একবার তাঁর ছেলেকে নিয়ে এলেন নোয়াখালীতে। ছেলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে মাস্টার্স পড়ছে আর বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করে পররাষ্ট্র ক্যাডারে মনোনয়ন পেয়েছে। স্যার নিয়ে এসেছেন বাড়িতে, এলাকা ও লোকজনের সংগে কিছুটা পরিচয় করিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। সে সাথে আমাদের সংগেও পরিচয় হল। তাঁর সংগে আমার কখনো কখনো যোগাযোগ হয়, অসাধারণ জ্ঞানী, পড়ুয়া এবং সংস্কৃতিবান একজন মানুষ, রিয়াজ হামিদুল্লাহ।
১৯৯৫-৯৬ সময়কালে বাংলাদেশে নতুন করে আনুষ্ঠানিকভাবে গণশিক্ষা কর্মসূচী শুরু করা হয়। আমার লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি মাটিরাংগা উপজেলার ইউএনও কাজী ফরিদ আহমদের কথা। ১৯৭৩ ব্যাচের এই অসাধারণ উদ্যোগী অফিসার অকালপ্রয়াত। তিনি যখন জেলা প্রশাসক লালমনিরহাট তখন স্থানীয়ভাবে গণশিক্ষা কর্মসূচী শুরু করেন। তা প্রাথমিক সাফল্য লাভ করে এবং প্রচারের আলোতেও আসে। এরপর তাঁর নিয়োগ হয় জেলা প্রশাসক রাজশাহী হিসাবে। রাজশাহীতেও তিনি একই কর্মসূচী গ্রহণ করেন। সরকার ধারনাটি গ্রহণ করে এবং দেশব্যাপী অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচী যখন গ্রহণ করা হয় তখন এর দায়িত্বে ছিলেন নোয়াখালীর এক সময়ের জেলা প্রশাসক খোন্দকার শহিদুল ইসলাম। নোয়াখালী জেলায় প্রথম পর্যায়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাকে এই প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত করা হয় আর কর্মসূচী’র সফল বাস্তবায়নের জন্য কোম্পানীগঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় আমার সেকেন্ড হোম।
কোম্পানীগঞ্জে তখন ইউএনও আমার ব্যাচমেট এএলএম আব্দুর রহমান এনডিসি আর সহকারী কমিশনার (ভূমি) গণিতের মেধাবী ছাত্র মোঃ নুরুজ্জামান। আমি প্রতিদিন অফিস শেষ করে কোম্পানীগঞ্জ চলে যাই। সন্ধ্যায় সেন্টারগুলো পাঠদান শুরু করে যা কোথাও কোথাও রাত ৯টা পর্যন্ত চলে। আর আমি এক ইউনিয়ন থেকে আরেক ইউনিয়ন, এক সেন্টার থেকে আরেক সেন্টার ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করতে থাকি। জেলা প্রশাসক কে এম ডি আবুল কালাম চান আমি যেন নিয়মিত কোম্পানীগঞ্জে রাত্রিযাপন করি। বাস্তবে তার কোন প্রয়োজন ছিল না কারণ সেন্টারগুলো বিলম্বে হলেও রাত ৯টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যেত আর কোম্পানীগঞ্জ থেকে সোনাপুরে আমার বাসা ছিল ৩০ মিনিটের পথ। ফলে আমি দু’একবার কোম্পানীগঞ্জ ডাকবাংলোতে রাত কাটালেও অধিকাংশ দিন রাত ১০টার দিকে ফিরে আসতাম। তবে এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য অনির্ধারিত সেন্টার ভিজিট অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। আকস্মিক অনির্ধারিত ভিজিট আর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সংগে মতবিনিময় ছিল এর সাফল্যের পূর্বশর্ত। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় পাইলট বাস্তবায়নের পরই পুরো জেলা এই কর্মসূচী’র জন্য গ্রহণ করা হয়।