সংসদ সদস্যদের চাহিদায় একদিনে ডিসি বদলী

জালাল আহমেদ

সোনাপুর আবাসিক এলাকাটি ছিল একটি দিঘী কেন্দ্রিক। দিঘীটিকে স্থানীয়ভাবে তারের দিঘী বলা হত। আমরা যখন ছিলাম তখন তারের দিঘী নাম আর প্রচলিত নেই। দিঘীকে ঘিরে রাখা তারের বেষ্টনীও উধাও হয়ে গিয়েছে। দিঘীর উত্তর পূর্ব কোনে পুলিশ সুপারের বাসভবন। আমার ব্যাচমেট অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অমূল্যভূষন বড়ুয়া তখন সেখানে থাকেন। দিঘীর উত্তর পাড়ে জেলা প্রশাসকের বাংলো, যেখানে আমি উঠেছি। উত্তর পশ্চিম কোনে সিভিল সার্জনের বাংলো, যেখানে একসময় আমার আব্বাও থেকে গিয়েছেন। দিঘীর পশ্চিম পাড়ে জেলা জজের বাংলো, সেখানে থাকতেন এডিএম আকরাম আলী মৃধা। তারপর পশ্চিম দক্ষিণ কোনে সাব জজের বাংলোতে পৌর বাড নার্সিং স্কুল। দক্ষিণ পাড়ে এডিসিদের বাংলোর জায়গায় সোনাপুর কলেজ। পূর্ব দক্ষিণ কোনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি রেস্ট হাউস ছিল। পূর্ব পাড়ে ছিল সার্কিট হাউস, সেখানে পরবর্তীতে বিআরটিসি বাস ডিপো হয়। ১৯২০-২১ সালে যখন বাংলোগুলো নির্মিত হয় তখনো নদী কাছে। বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, “এই বাংলোটি ছিল শহরের দক্ষিণ প্রান্তে আমার ছেলেবেলার নোয়াখালীর সেটাই অভিজাত পল্লি। সুন্দর বেড়াবার রাস্তা, ঊর্ধ্বতন সরকারী চাকুরেদের জন্য বড় বড় কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়ি, পানীয় জলের জন্য সুরক্ষিত চোখজুড়োনো ‘বড় দিঘি’ – এই সব ছিল সেখানে, আর আমি কিছুটা বড় হয়ে উঠতে-উঠতে এই সবই জলের তলায় অদৃশ্য হয়েছিল।”।
ডে যখন কালেক্টর হয়ে এলেন তাঁর মন টন খুব খারাপ, এতো জেলা থাকতে ভাংগন কবলিত নোয়াখালী জেলায় তাঁর পোস্টিং! আগের কালেক্টর সাহেব, ধুতি পরে, নামাবলী গায়ে দিয়ে খোল করতাল বাজিয়ে, নদীর পাড়ে পাড়ে কীর্তন গেয়েও ভাংগন ঠেকাতে পারেননি। ডে যে বাংলোতে থাকতেন তার বেডরুম ছিল ৬০ ফিট বাই ৪০ ফিট, তার সংগে বারান্দা ছিল ২০ ফিট বাই ৬০ ফিট। ২৪০০ বর্গফিটের বেডরুমের মাঝখানে ছিল তাঁর পালঙ্ক। যখন ভাংগনে তিনি বাড়ি হারালেন, তখন আশ্রয় নিলেন সোনাপুরে। বুদ্ধদেব বসু লিখছেন, “আর এইসব কিছুর উপরে আছে ভাংগন, অনিবার্য অপ্রতিরোধ্য ভাংগন। প্রতি বর্ষায় নদী এগিয়ে আসে শহরের মধ্যে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে, বিরাট বুড়ো বটগাছ আর অগুনতি পাখির বাসা নিয়ে মস্ত বড়ো মাটির চাই ধ্বসে পড়ে হঠাৎ, ধোঁয়া ওঠে জলের মধ্যে কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই নদী আবার নির্বিকার। আমি একাধিকবার এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলাম – একবার কিছুটা বিপজ্জনকভাবে। শোনা গেল অমুক সাহেবের বাংলোকে নদী ধরে ফেলেছে, তিনি সব জিনিসপত্র সস্তায় বেঁচে দিয়ে চলে যাচ্ছেন রোববার সকালে। দাদামশাই আমাকে নিয়ে হাজির হলেন সেখানে, আমার পড়ার মত কোন বই যদি বা পাওয়া যায়। আমরা যখন একমনে বই দেখছি, ঠিক তখনই প্রচন্ড শব্দে পাশের ঘরটি ধ্বসে পড়ল। একটি ফিরিঙ্গী যুবক জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাল, বরাতজোরে সে ঘরে তখন আর কেউ ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে সব লোক বেরিয়ে এল রাস্তায়, দাদামশাই কাঁপতে কাঁপতে আমার হাত ধরে বাড়ির পথ ধরলেন, কিন্তু তাঁর আগেই তিনি জুটিয়ে ফেলেছিলেন আমার জন্য এক বান্ডিল বাছা বাছা বই।”
১৯৫৭ সালে নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছিলেন মাহবুবুর রহমান, নুরুল কাদের খানের পর তিনি বাংলদেশের দ্বিতীয় সংস্থাপন সচিব। তাঁর আত্মজীবনী ‘ কিছু স্মৃতি কিছু ধৃতি’তে তিনি উল্লেখ করেছেন বাসা থেকে দুইশ গজ দূরে সমুদ্র। তিনি থাকতেন দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে এডিসি কোয়ার্টারে। ১৯১৯ সালেই বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে ৬০০ একর জমি হুকুম দখল করা হয় জেলা সদর করার জন্য। আংশিক ভাংগনের পর ভাংগন থেমে গেলে জেলা সদর আর পরিবর্তন করা হল না। ১৯৪৮-৪৯ সালে ভাঙ্গন আবার তীব্র হয়ে কালেক্টরেটসহ অফিস আদালত নিয়ে চলে গেল। তবুও মানুষজন জেলা সদর চৌমুহনীতে নিতে দিবে না। তখন বাধ্য হয়ে মাইজদীতে আরো ৪০৩ একর জমি হুকুমদখল করে জেলা সদর স্থাপন করা হল। মাইজদী জেলা সদরের কেন্দ্রীয় অংশ সরকারি হুকুম দখল করা জমিতে বলে এই শহরের আর উন্নতি হল না। এদিকে চৌমুহনীর ৬০০ একর জমি সরকার কখনো পজেশনে যায় নাই। তবে এখান থেকে ২০০ একর জমিতে ডেল্টা জুট মিল, বিসিক শিল্প নগরী, কৃষি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, উপজেলা পরিষদ, কারিগরী বিদ্যালয় ইত্যাদি স্থাপন করা হয়। ডেল্টা জুট মিলকে দেয়া হয় ৬০ একর জমি।
অনেক কথাই বলছি আসল কথা বাদ দিয়ে, আসল কথা হল যে আমি এডিসি নোয়াখালী হিসাবে যোগদান করেছি ঠিকই কিন্তু দায়িত্ব পাবার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসনের কথিত রাজনীতিকরণের কেবল শুরু। যে কারণে আমার এডিসি পদায়নে বিলম্ব হল সেই একই কারণে আমি এখন দায়িত্ব পাচ্ছি না। নোয়াখালীকে মনে করা হত বিএনপি প্রভাবান্বিত জেলা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িও বৃহত্তর নোয়াখালীতে। নোয়াখালীর সংসদ সদস্যদের একটা প্রাধিকার ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানোর। ফলে তাঁরা ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন এবং তা জাহিরও করতেন। নোয়াখালীতে সে সময়ে অপর দু’জন এডিসি ছিলেন ১৯৮১ ব্যাচের এডিসি (রাজস্ব) আব্দুস সোবহান সিকদার এবং আমার ব্যাচমেট মোঃ তরিকুল ইসলাম। এর আগের এডিসি সাহেবরা মুরুব্বী ঠিক রেখেই এখানে চাকুরী করতেন যা আমার এই দুই সহকর্মী অনুসরণ করতেন না।
আকরাম আলি মৃধা সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদীন ফারুককে ধরলেন নোয়াখালীতে থাকার জন্য। নোয়াখালী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন একই ব্যাচের আবুল মনসুর। তাঁকে সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদে বদলী করে আকরাম আলি মৃধাকে এই পদে নিয়োগ দেয়া হল। মনসুর সাহেব গিয়ে মুরুব্বী ধরলেন সংসদ সদস্য বরকত উল্লাহ বুলুকে। ফলে তাঁর বদলীও থেমে গেল। এদিকে আমি সোনাপুরের সেই পোড়ো বাংলোতে ছোট শিশু সন্তান নিয়ে থাকি। সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ চলে যায়, কোন পদে না থাকায় অন্য কোন লোকবলের সাপোর্টও নাই। এডিসি (সার্বিক) বন্ধু মোঃ তরিকুল ইসলাম প্রতিদিন সকালে তাঁর গাড়িতে করে আমাকে অফিসে নিয়ে আসে। দু’টায় লাঞ্চ করতে বাসায় যাই, আবার তিনটায় অফিসে আসি পাঁচটায় ছুটির পর ফিরে যাবার জন্য। তরিক নিজের ফ্ল্যাটে কখনো কখনো হেঁটে যায় কিন্তু আমাকে গাড়ি দিতে তাঁর কখনো ভুল হয়নি। তিনমাস তিনদিন ধরে সহকর্মীর প্রতি লাগাতার এমন সহমর্মিতা আমার চাকুরী জীবনে আমি আর কখনো কোথাও দেখিনি। এই তিরানব্বই দিন আমি নিয়মিত অফিস করেছি। তদবির করতে ঢাকায় গিয়েছি এমন কানাঘুষা যেন না হয় এ কারণে একদিনের জন্য নোয়াখালীর বাইরেও যাইনি।
জেলা বিএনপির সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট এবিএম জাকারিয়া পরামর্শ দিলেন সদরের সংসদ সদস্যের সংগে দেখা করার জন্য। আমি বললাম মন্ত্রীর সংগে দেখা করলেতো আমি চট্টগ্রামের এডিসিই হতে পারতাম। নোয়াখালীতে কাজ করার জন্য এমপি’র সংগে দেখা করার প্রয়োজন নেই। একপর্যায়ে ঢাকা থেকে সিদ্ধান্ত এল যে আকরাম আলি মৃধাকে বদলীকৃত কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে। তারপর প্রশ্ন উঠলো যে আমি এডিএম হব কিনা? তখনকার বিধান অনুযায়ী জ্যেষ্ঠ এডিসি হবেন এডিএম, সে হিসাবে আব্দুস সোবহান সিকদার হবেন এডিএম। কিন্তু বিভাগীয় কমিশনার চান আমি এডিএম হই, তিনি এ বিষয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পত্রালাপও করলেন। সিদ্ধান্ত এল যে জ্যেষ্ঠতম এডিসিই হবেন এডিএম। ১৮ জুন ১৯৯৫ তারিখে আমি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নোয়াখালী’র দায়িত্বভার গ্রহণ করি।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুস সোবহান সিকদারকে জিজ্ঞেস করলাম বিভাগীয় কমিশনার কেন তাঁকে এডিসি (রাজস্ব) রাখতে চেয়েছিলেন, তাঁর কোন স্বার্থ রয়েছে কি না? তিনি বললেন যে এমন কিছুই নেই। উল্লেখ্য যে, আমার তিন বছরের নোয়াখালীর চাকুরীতে বিভাগীয় কমিশনার কোন বিষয়ে সামান্যতম প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করেন নাই।
এই পুরো সময় জেলা প্রশাসক মশিউর রহমানের কোন ভূমিকা ছিল না, তিনি ছিলেন নীরব দর্শক। এর আগে ডিসি ছিলেন হাসানুজ্জামান। তখন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ইন্টারভিউ চলছিল এবং সংসদ সদস্যরা জেলা প্রশাসককে তালিকা ধরানোর চেষ্টা করছিলেন। জেলা প্রশাসক সম্মত না হওয়াতে তাঁরা বললেন যে একদিনের মধ্যে তাঁদের নতুন ডিসি চাই। একদিনের মধ্যে মশিউর রহমানের পদায়ন আদেশ হল। মশিউর রহমান তখন উপ-পরিচালক, দুর্নীতি দমন ব্যুরো, ময়মনসিংহ, ঐদিন তিনি ঢাকাতে। মহাপরিচালক, দুদক তাঁকে খুঁজে বের করলেন, গাড়ীতে করে দাউদকান্দী ফেরীতে পৌঁছে দিলেন। অপর পাড়ে ডিসি কুমিল্লা গাড়ি পাঠিয়েছেন, রাতে কুমিল্লায় থেকে পরদিন কুমিল্লার ডিসি’র গাড়িতে দেহরক্ষী নিয়ে তিনি নোয়াখালী হাজির হয়ে একদিনও সময় না দিয়ে ঐদিনই দায়িত্ব নিলেন। তবে তিনি যখন বদলী হন তখন নবাগত ডিসিকে সার্কিট হাউজে দিনের পর দিন অপেক্ষমান রেখে সারা জেলা জুড়ে বিদায় সংবর্ধনা নিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এই বিষয়ে জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হবার পর তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।