নোয়াখালীতে নোয়াখালী নাই
জালাল আহমেদ
১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ আমার বড় ছেলে ৫ বছরের আসিফ আহমেদ ভিক্টরসহ এলাম নোয়াখালীতে। যোগদান করে সোনাপুরের বাসা দেখতে গেলাম। সোনাপুর হল পুরনো নোয়াখালী শহরের উত্তরের এক্সটেনশন। পুরনো শহরের কিছুই আসলে অবশিষ্ট নাই। বলা হয়ে থাকে যে নোয়াখালীতে নোয়াখালী নাই! তাহলে নোয়াখালী কোথায়? নতুন মানুষের পক্ষে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমি যেহেতু ১৯৭৫ সাল থেকে নোয়াখালী যাতায়াত করি তাই আমার জন্য খুঁজে পাওয়া অত কঠিন ছিল না। তবে বহুজনের ঢাকা থেকে নোয়াখালীর বাস খুঁজে না পাওয়ার গল্প আছে। কারণ ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে সব বাসই যেত সোনাপুর। আপনি যেতে চান নোয়াখালী, কোন সজ্জন এসে আপনাকে সোনাপুরের বাসে তুলে দিয়ে গেল এই বলে যে এই বাস নোয়াখালী হয়ে সোনাপুর যাবে। আপনিতো আরামসে ঝিমাচ্ছেন, বাস চৌমুহনী পার হলে কান খাড়া করে রাখলেন, কন্ডাক্টর কত কিছু বলে কিন্তু নোয়াখালী আর বলে না। একসময় বাস সোনাপুরে, আপনার সাধের নোয়াখালী আর পেলেন না। সোনাপুর নামলেন, কিন্তু নোয়াখালী আর নাই, জেলা সদরে যাবেন? আবার ফিরতি পথ, কিন্তু নোয়াখালী নয়, জেলা সদর মাইজদীতে, আর সদর থানা হল সুধারাম। যে কারো জন্য বিভ্রান্ত হওয়া একদম সহজ!
নোয়াখালী জেলা এক ভাঙ্গাগড়ার জেলা। মিথিলার রাজা আদিশুর যাবেন সাগর সঙ্গমে বারাহী দেবীর পুজো দিতে। এক কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে তাঁর লোকজন ভাবলো যে মোহনায় পৌঁছে গেছে। তারা রাজাকে নামিয়ে দিল, পুজো সম্পন্ন হল কিন্তু কুয়াশা কেটে গেলে তারা দেখলো যে ভুল জায়গায় নেমেছে। সবাই চীৎকার করে উঠলো ভুল হুয়া, ভুল হুয়া! জায়গার নাম হয়ে গেল ভুলুয়া। জেলা পদ্ধতি শুরু হয় ১৭৭২ সালে, এরপর অল্প সময়ের জন্য পাঁচ প্রদেশ করা হয় আবার জেলায় ফেরত যাওয়া হয়। ঐসময়ে প্রথম নোয়াখালী জেলার জন্ম। তখন চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও যশোরে লবন উৎপাদন হত। যশোর এবং চট্টগ্রাম প্রথম দফায় জেলা হলেও নমক মহালকে কেন্দ্র করে ১৭৮১ সালে ভুলুয়া নামে নোয়াখালী জেলার জন্ম হয়। কিন্তু বিধি বাম, ১৭৮৬ সালে এই জেলা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর সদর কোথায় ছিল আমি অন্তত জানি না, তবে বলা হয় লক্ষ্মীপুরে ছিল এর সদর। ১৭৮৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা হয় এবং উত্তরে বকশিগঞ্জ থেকে দক্ষিণে সোনাগাজি পর্যন্ত বিশাল এক জেলার জন্ম হয়। যদিও ময়মনসিংহ সদর থেকে সরাসরি কুমিল্লা অঞ্চলে পা ফেলার কোন উপায় ছিলনা। তাই সিলেট জেলা থেকে সতেরোসতি বা সতেরোখন্ডাল পরগনা এবং চাকলা রোশনাবাদ (বর্তমান নাসিরনগর, বিজয়নগর, সরাইল ও আশুগঞ্জ) কেটে ময়মনসিংহের সংগে যুক্ত করা হয়।
ময়মনসিংহের প্রথম কালেক্টর ডাব্লিউ রটনকে অন্য কালেক্টরদের মতই দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁর জেলার রাজস্ব প্রতিবেদন তৈরী করার জন্য। এরকম তিনটি অসাধারণ প্রতিবেদন আমি পড়েছি। এর একটি রংপুর জেলার উপর ‘এ রিপোর্ট অন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অফ রংপুর’, লিখেছিলেন ই জি গ্লেজিয়ার। যশোর এর উপর জেমস ওয়েস্টল্যান্ড এর লেখা ‘এ রিপোর্ট অন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অফ যশোরঃ ইটস এন্টিকুইটিস, ইটস হিস্টরি, এন্ড ইটস কমার্স’। ডাব্লিউ রটন ১৭৮৭ সালে অত্যন্ত দক্ষতার সংগে এই বিশাল জেলা সম্পর্কে তাঁর এই প্রতিবেদন লিখেন। কেদারনাথ মজুমদার এই প্রতিবেদনের ময়মনসিংহ অংশ অনুবাদ করে তাঁর ময়মনসিংহের বিবরণ প্রকাশ করেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিসে ১৯২৪ সালে টাইপ করা প্রতিবেদনের নোয়াখালী জেলার অংশ আমি রাজস্ব রেকর্ড রুমে পাই। আমি এটা অনুবাদও করি, অর্থাৎ পুরোটাই আমি পড়ার সুযোগ পাই। এর কুমিল্লা অংশ আমি কখনো দেখিনি আর এটি অখন্ড অবস্থায় আদৌ প্রকাশ হয়েছিল কি না তা আমার জানা নেই। তবে ঐ সময়কালের কালেক্টরদের প্রতিবেদন ও অন্যান্য বাস্তবতার ভিত্তিতে ৫ সনা, ১ সনা, ১০ সনা হয়ে ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হয়।
এর কিছুদিন পরেই ময়মনসিংহ ভাগ হয়ে ১৭৮৯ সালে কুমিল্লা জেলার জন্ম হয় কিন্তু সিলেট থেকে কেটে নেয়া অংশ আর সিলেটকে ফেরত দেয়া হয়নি, তা কুমিল্লার অংশ হিসাবেই রয়ে যায়। কুমিল্লা থেকে কেটে ১৮২২ সালে নোয়াখালী জেলা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৪০ সালের নোয়াখালী জেলা সদরের বর্ণনায় ঘোড়দৌঁড়ের মাঠসহ লাল মোরাম বিছানো ঝাউগাছের সারিবাঁধা রাস্তার বিবরণ পাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিখ্যাত জেলা প্রশাসক ক্যাপ্টেন টি এইচ লেউইন ১৮৬৪-৬৫ সালে নোয়াখালীতে পুলিশ সুপার ছিলেন, তাঁর আত্মজীবনীতেও নোয়াখালী শহরের বিবরণ পাওয়া যায়। লেউইন তার আত্মজীবনী এ ফ্লাই অন দ্য হুইল এ লিখেছেন ” ও যধফ ংববহ সধহু ফঁষষ ওহফরধহ ংঃধঃরড়হং, নঁঃ ভড়ৎ ংঃবধফু ধহফ ঢ়বৎংরংঃবহঃ ফঁষষহবংং ঘড়ধপড়ষষু ংঁৎঢ়ধংংবফ ঃযবস ধষষ.”। ডে সাহেব ছিলেন ১৯১৯-২০ সালে নোয়াখালীর কালেক্টর, তাঁর সময়ে কালেক্টরের বাসভবন নদীতে ভেংগে যায়। ১৯২১ সালে আরেকটি বাংলো বানানো হয়, যে বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমার একটি ছবি রয়েছে। তার পূর্ববর্তী কালেক্টর সংকীর্তন এর দল নিয়ে ধুতি পরে নদীভাংগন ঠেকানোর জন্য গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে বেড়াতেন। কয়েকদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় বর্তমানে কোন জেলার লোক ঢাকায় বেশি অভিবাসন করছে এই তথ্যে এক নাম্বারে ভোলা জেলার নাম পাওয়া যায়, বিশ শতকের শুরুতে নিশ্চিতভাবেই এক নাম্বার ভাংগন কবলিত জেলা ছিল নোয়াখালী।
কথিত আছে যে বর্তমান মায়ানমার থেকে কালেক্টরের নতুন বাংলোর জন্য কাঠ আনা হয়েছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বরে, ১০০ বছর পরেও পরিত্যাক্ত এই বাংলোকে মজবুত অবস্থায় আমি দেখে এসেছি। জেলা প্রশাসক যেমন বলেছিলেন যে বাচ্চারা বারান্দায় ফুটবল খেলতে পারবে, বাস্তবেও তাই, ১১৮ ফুট লম্বা ও ১৫ ফুট চওড়া বারান্দা। এর সর্বশেষ বাসিন্দা ছিলেন ১৯৭৩ ব্যাচের বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম মাহবুবুল আলম। তিনি যাবার পর তিনমাস বাসাটি খালি ছিল, অবস্থা খুব একটা ভালোনা। তাও ভাবলাম যে নোনা ধরা মাইজদীর ফ্ল্যাটে থাকার চেয়ে ১০ বিঘার প্রাচীন বাংলোতে থাকাই ভালো। ভিক্টরকে নিয়ে আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসলাম ঐদিনই। ১৮ মার্চ আবার ফিরে এলাম নোয়াখালী। এসে টের পেলাম যে আমাকে যার জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আকরাম আলি মৃধা তিনি নোয়াখালী থেকে যেতে ইচ্ছুক নন। ফলে কবে দায়িত্ব পাবো তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেলাম।
এদিকে পরিবার স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল এবং দায়িত্ব পেয়ে যাবো এই প্রত্যাশায় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ৪৩ দিনের অক্ষরসহ সপরিবারে নোয়াখালী চলে আসলাম। সংগে আমার আম্মা জধনবুধ জধযসধহ এবং শ্বশুর শাশুড়িসহ অন্যরা ছিলেন। বসবাস শুরু হল সোনাপুরের সেই প্রাচীন বাংলোতে। আগেই উল্লেখ করেছি যে নোয়াখালী শহরের অফিসারদের বাংলোগুলো মেঘনায় ভেংগে গেলে সোনাপুরে জমি হুকুমদখল করে নতুন করে আবাসিক এলাকা করা হয়। তখন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কে সি দে, যার নামে চট্টগ্রামে একটি রাস্তা রয়েছে। কে সি দে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ থেকে আগস্ট ১৯০৪ সালে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন। বলা হয় যে কে সি দে হরিনারায়নপুর এর জমিদারদের উপকার করার জন্য তাঁদের জমি হুকুমদখল করে এই আবাসিক এলাকা নির্মাণ করেন। তখনো একটি দ্বীপের মাঝে কালেক্টরেট বিল্ডিং ছিল। লোকজন এবং স্টাফদের নৌকা করে সেখানে যেতে হতো বলে ১৯৪৫-৪৭ সালে জেলা প্রশাসকের গোপনীয় সহকারী ছিলেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আমাকে বলেছেন।