পিতা পুত্রের হারিয়ে যাবার গল্প
জালাল আহমেদ

আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে আমার ছেলেবেলা কেটেছে চট্টগ্রামে। আমার প্রথম ও দ্বিতীয় স্কুলও তাই চট্টগ্রামে। ১৯৬৫ সালে জামাল খান এর সেইন্ট মেরী স্কুলে আমি ভর্তি হই। দু’বছর নির্বিঘেœই লেখাপড়া চলে ঐ স্কুলে। বিপত্তি ঘটে স্কুল বহির্ভূত কারণে। একদিন কিছু বন্ধুর সংগে মিলে সমুদ্র দেখার শখ হলে পাশের মহসিন কলেজের পাহাড়ের উপর উঠি। তখন মহসিন কলেজের পাহাড় থেকে সমুদ্র পরিস্কার দেখা যেত। সমুদ্র দেখতে দেখতে আর সময়ের দিকে খেয়াল নেই। বাসায় ফিরতে হবে তাও আর হুশ নাই! এদিকে বাসায় হইচই, আব্বাকে খবর দিয়ে অফিস থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। যে দাদু আমাকে স্কুলে আনা নেয়া করতেন তিনি আমাকে স্কুলে না পেয়ে ফিরে এসেছেন। আমার আব্বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমার চেয়ে দ্রুত ছিলেন, রিক্সা করে মাইক বেরিয়ে গেল, ‘একটি ছেলে হারানো গিয়েছে!’ এরমধ্যে আমি ফিরেছি মাইকের শব্দের মাঝেই। ফল দাঁড়ালো গিয়ে ১৯৬৭ থেকে নতুন স্কুল, কাওয়া স্কুল, গুল এ জার বেগম বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের এই আবুল কাসেম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হল আমার নতুন স্কুল। কারণ পাশের বালিকা বিদ্যালয়ে আমার বড় বোন পড়েন। ছুটির পর বোনের স্কুলে অপেক্ষা আর একসংগে স্কুল থেকে ফেরা। ঐ বছরেই চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় ধানমন্ডি হাইস্কুল, হাতিরপুলে, সে অন্য গল্প।
আমি একদিন কোর্টে এক মামলার সাক্ষ্য নিচ্ছি, সাক্ষী আবুল কাসেম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সাক্ষী যখন স্কুলের লোকেশন বলছে আমার সন্দেহ হল যে এই সেই স্কুল কি না? জিজ্ঞাসার জবাবে সাক্ষী জানালো যে হ্যাঁ, এর আরেক নাম কাওয়া স্কুল। আমি বললাম যে আমি ঐ স্কুলের ছাত্র, পুরনো রেজিস্ট্রার পেলে হয়তো আমার নামও পাওয়া যাবে। সাক্ষ্যের পরবর্তী দিনে সাক্ষী ঠিকই রেজিস্ট্রার নিয়ে আসলেন যাতে আমার নামও রয়েছে।
১৯৯৪ এর ১২ জানুয়ারি বিকেলে আমি কোর্ট থেকে বাসায় ফিরে দেখি আমার বড় ছেলে ভিক্টর বাসায় নেই। আমার স্ত্রী জানালেন ভিক্টর আমার এক মামাতো বোন যিনি পাশের বিল্ডিং এ থাকেন, দুলাভাই চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, তাঁর সংগে আমার আরেক মামাতো বোনের বাসা আগ্রাবাদ বেপারী পাড়ায় গিয়েছে। আমি সংগে সংগেই বললাম যে তুমি কাজটা ঠিক করোনি। আপার নিজের বাচ্চা সাতজন এবং তিনি তাঁদের সামলাতেই নাস্তানাবুদ থাকেন। সন্ধ্যার দিকে কলিং বেল বাজলো, দরজা খুলে দেখি দু’টো ছেলে এবং তাঁদের একজনের কোলে ভিক্টর। আমি দেখেই বুঝেছি যে কি হয়েছে। ভিক্টরকে তাঁদের কাছ থেকে নিজের কোলে নিলাম এবং ছেলে দু’টোকে বসতে দিলাম। তাঁদের কাছ থেকে ঘটনা শুনছি আর আগ্রাবাদে খবর পাঠানোর চেষ্টা করছি যে ভিক্টর বাসায়।
ওদিকে তারাও মাইক বের করার ব্যবস্থা করে ফেলেছে, খবর না পেলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাইক বের হয়ে যেত। ভিক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম যে কি হয়েছিল। হয়েছিল আমি যা ভেবেছিলাম তাই। সবাইকে নিয়ে মাইক্রোবাস যখন আগ্রাবাদে আম্বিয়া আপার বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সবাই গাড়ি থেকে নেমে দুদ্দাড় সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। আপার বাসা সম্ভবতঃ তিন তলায় ছিল। ৪ বছরের ভিক্টর যখন তাঁর ছোট ছোট পায়ে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে উঠলো সে কোন দরজা খোলা পেল না। তখন সে আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো, এসে দেখে তাঁদের নামিয়ে দেয়া মাইক্রোবাসও গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। সে দৌড়ে মাইক্রোবাসকে অনুসরণের চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যে সে মাইক্রোবাসও হারিয়ে ফেললো, হারিয়ে ফেললো বাসাও। ফলে বাসা থেকে নেমে ওরাও তাঁকে খুঁজে পেল না। এদিকে সব হারিয়ে ভিক্টর কান্না শুরু করলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর যথারীতি লোক জমায়েত হয়ে গেল। জিজ্ঞাসাবাদে সে আমার নাম বলতে পারলো, আমি যে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট তা বলতে পারলো এবং লালখান বাজার ম্যাজিস্ট্রেট কলোনীতে বাসা তাও বলতে পারলো। এই ছেলেদু’টোর বাসা ছিল কাছেই জিইসি মোড়ে, তারাও সেখানে বেড়াতে গিয়েছিল এবং তারা দায়িত্ব নিয়ে ভিক্টরকে বাসায় নিয়ে এসেছিল। আমি শুধুই ভাবছিলাম যে সঠিক হাতে না পড়লে কি হতো! মানুষের জীবন কত সহজে এ সকল টার্নিং পয়েন্টে এসে বদলে যায়!
তিনদিন পর ১৬ জানুয়ারি ১৯৯৪, ভিক্টর এর প্রথম স্কুল, আমরা স্বামী স্ত্রী রিক্সা করে তাঁকে নিয়ে লালখান বাজার থেকে জামালখান রওয়ানা হলাম। চট্টগ্রামের ঢেউ খেলানো রাস্তা অনেক সময়ই রিক্সাচালকের জন্য কষ্টকর হয়ে যায়। আসকর দিঘী পার হয়ে রিক্সা যখন ঢালুতে, দ্রুত নেমে যাচ্ছে স্কুলের সামনের ট্রাফিক পয়েন্টের দিকে, তখনই অন্য একটি রিক্সার চাকার সংগে লেগে আমাদের রিক্সা উল্টে গেল, আমরা সবাই রাস্তায় কিন্তু বেশি আঘাত পেল ভিক্টর। তাঁর হাতের উল্টো দিকের চামড়া ছিড়ে গেল অনেকখানি। তাঁকে নিয়ে জামালখান রোডে গেলাম একটা ফার্মেসীতে, হাত ব্যান্ডেজ করালাম, তারপর তাঁকে নিয়ে স্কুলে। আমার ২৯ বছর পর আমার ছেলে একই স্কুলে গেল। সে সাহসের সংগেই বিনা আপত্তিতে আহত অবস্থায় ক্লাসের দিকে চলে গেল। দুপুরে ছুটির সময় আবার তাঁকে যখন আনতে গেলাম সে স্কুল গেট থেকে বের হয়েই কান্নায় ভেংগে পড়লো। সারা সকাল দুপুরের সমস্ত আবেগ, উৎকণ্ঠা, আঘাতের ব্যাথা তাঁর চোখ দিয়ে জল হয়ে বের হয়ে আসতে লাগলো। আহত অবস্থায় সাহসের সংগে তাঁর প্রথম দিনের স্কুলে যাওয়া সবসময় মনেপড়ে – আমার সাহসী ছেলে!
একে একে চট্টগ্রামে চারবছর কেটে গিয়ে পঞ্চম বছরে পদার্পণ। আমি নিজে খোঁজ খবর নিলেও আমার বদলির কোন খবর হচ্ছিল না। ১৯৯৪ এর সেপ্টেম্বরে আমার ব্যাচে আমার কনিষ্ঠ কর্মকর্তা এডিসি হলেও আমার এডিসি হবার কোন লক্ষণ ছিল না। একাধিকবার আমার নথি উত্থাপিত হলেও তা আটকে যাচ্ছিল। একবার সুনির্দিষ্টভাবে কক্সবাজারের এডিসি পদে আমার পদায়ন প্রস্তাব থাকলেও তা আর আগায়নি। শোনা যাচ্ছিল এর পেছনে চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনের সময় জনৈক মন্ত্রীর আমার উপর অসন্তুষ্টির ভূমিকা রয়েছে। নীতিগতভাবে আমি আমার পদায়ন নিয়ে কোন রকম তদবিরের পক্ষপাতি নই। কিন্তু যখন আমাকে অতিক্রম করে আমার ব্যাচের একাধিক কনিষ্ঠ কর্মকর্তার পদায়ন হয় তখন বাধ্য হয়ে আমি বিভাগীয় কমিশনার চট্টগ্রামের সংগে দেখা করলাম। বিভাগীয় কমিশনার শেষ ব্যাচের সিএসপি শফিকুল ইসলাম। তাঁকে বললাম যে স্যার বর্তমান পদে আমি চার বছরের বেশি আছি, আমার কনিষ্ঠ অনেক কর্মকর্তা এডিসি হয়েছেন, কক্সবাজারে পদ খালি হবে, আমাকে দেবার জন্য বলতে পারেন। কমিশনার বললেন যে নোয়াখালীতে এডিএম পরিবর্তন করা দরকার, তুমি নোয়াখালীতে আসো। আমিতো আর বলতে পারি না যে, যে সব জেলায় আমি কাজ করতে চাই না তার একটি হল নোয়াখালী, কারণ কমিশনারের বাড়ি নোয়াখালী। তবুও বললাম আমার আপত্তি নেই।
বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সচিব তখন মোস্তফা কামালউদ্দিন, বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব। বিকেলেই তিনি আমাকে জানালেন যে স্যার আপনার পদায়নের জন্য বলা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে আদেশ হয়ে গেল। কমিশনারের সংগে দেখা করলে তিনি বললেন ডিসি নোয়াখালী আসবেন, তাঁর সংগে দেখা করে মুভমেন্ট প্লান করে ফেলেন। জেলা প্রশাসক নোয়াখালী ১৯৭৩ ব্যাচের মশিউর রহমান এর সংগেও চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দেখা করলাম। তিনি বললেন আমি যে কোনদিন গিয়ে যোগদান করতে পারি এবং সোনাপুরে অবস্থিত প্রাক্তন জেলা প্রশাসকের বাংলো খালি আছে, যার বিশাল বারান্দায় বাচ্চারা ফুটবল খেলতে পারে, তাই আমি পরিবার সহও মুভ করতে পারি। নোয়াখালী আমার পরিচিত জায়গা, আমার এক মামা সেখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের উপ বিভাগীয় ও নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত। আমার আব্বা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন সেখানে ১৯৮৩ সালে। ফলে ১৯৭৫-৮৪ সময়কালে আমি কমপক্ষে দশবার নোয়াখালী বেড়াতে এসেছি তবে এবার যেতে হবে দায়িত্ব পালনে।