জালাল আহমেদ

মসজিদে তারাবিহ নামাজ পড়ছি, এমন সময় শুরু হলো অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র থেকে বিরতিহীন গুলি

এরপরের দিনগুলো নিরুত্তাপই কেটে যাচ্ছিল। প্রতিদিন ভোরবেলা রাইফেল হাতে ৩-৪ মাইল হাঁটি, সকালে কোর্ট, দুপুরের খাবারের পর উপজেলা অর্থ অফিস কারণ ইতোমধ্যে নাজিম উদ্দিন চৌধুরী লক্ষ্মীছড়ি উপজেলায় বদলি হয়ে গিয়েছেন। দুর্গম উপজেলা, সুলতান আহমেদ চৌধুরী ছিলেন ইউএনও, কিন্তু নাজিমের জন্য ক্লোজ টু চট্টগ্রাম। পানছড়ি উপজেলা সদরের পশ্চিমে ঝর্নাটিলা, পুরনো নাম পানিটিলা, ওখানে একটি কোম্পানী সদর ছিল। মেজর আনিস, কমান্ডো, ছিলেন কোম্পানী কমান্ডার। অনেকবারই যেতে বলেছেন, সেখান থেকেও ক্যাম্পের ডাল-রুটি খেয়ে বেরিয়ে এলাম।
শীতকাল কেটে বসন্ত সমাগত, পানছড়ি উপজেলায় কোন শহীদ মিনার ছিলনা যেখানে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়। এ বিষয়ে আগে হয়তো কেউ চিন্তা ও করেন নি। উদ্যোগ নিয়ে উপজেলা আদালত ভবনের প্রাঙ্গণে একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার বানানো হলো যেখানে একুশের ভোরে আমরা পুস্পস্তবক অর্পণ করতে পারলাম।
বসন্ত বিদায়ে গ্রীষ্ম দিয়ে নতুন বছরের শুরু পাহাড়ে সবসময়ই বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় হয়ে থাকে। তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানাদি থাকে। এখন যেমন বৈসাবী উৎসব হয়ে থাকে তখনো বৈসাবী আকারে তা শুরু হয়নি। তবুও ফুল ভাসানোর ফুল বিজু, মূল বিজু আর আলস্যে গড়াগড়ি খাবার গইজ্জ্যা গইজ্জ্যা মিলিয়ে ধুমধাম করেই তা হতো। এদিকে জেলা প্রশাসক মহোদয় জানালেন যে নববর্ষ উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠান হবে। ফুল বিজু’র মূল অনুষ্ঠান নদীতে ফুল ভাসানো দেখলাম বাজারের দক্ষিনে চেংগী পাড়ে উল্টাছড়ির একটি গ্রামে। আমিও সেখানে আমন্ত্রিত। আগেরদিন খবর এলো যে আব্বা গুরুতর অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি নিয়ে হবিগঞ্জ চলে যাই এবং বিজু’র মূল দিনটা মিস করি।
আব্বাকে দেখে কয়েকদিন পর ফিরে আসি। এদিকে রোজা শুরু হয়েছে, গ্রীষ্মকালের দীর্ঘদিনের রোজা। উপজেলা পরিষদ আঙ্গিনাতেই মসজিদ, সেখানে তারাবিহ নামাজ পড়ি। আগেই উল্লেখ করেছিলাম পুরনো ইউএনও বাংলোর দক্ষিণে একটি কৃত্রিম লেক। লেকের পশ্চিমে চেংগী নদী, একটি সরু পাড় দ্বারা বিভক্ত। লেকের দক্ষিণ পাড়ে একটা সরু রিজ (উচু প্রাকৃতিক পাড়), লেকের পূর্ব পাড়ে মসজিদ। মসজিদ পরিষদ মাঠ থেকে একটু নীচে, সিঁড়ির তিন/চার ধাপ হয়ে নীচে নামতে হয়। পুরনো পাকা সিঁড়িটা তুলে নীচেই মসজিদ প্রাঙ্গণে রাখা। মসজিদের সামনে, উঁচুতে, মাঠের লেভেলে একটি বেল গাছ। মসজিদের পশ্চিমে লেক, মসজিদ সংলগ্ন পশ্চিম থেকেই সরাসরি নীচে নেমে গিয়েছে। লেকের পশ্চিমে নদী, যেমনটা আগে বলেছি। ব্যাটালিয়ন সদরের অফিসার এবং সৈনিকরাও এই মসজিদে নামাজ পড়তেন। তারাবিহ পড়াতেন ১৯ ইস্টবেঙ্গল এর এক সুবেদার মেজর, যার নাম ছিল সম্ভবতঃ মুজিবর রহমান।
২৯ এপ্রিল, ১৯৮৬ সম্ভবতঃ ১৩ রোজা, তারাবিহ নামাজ পড়া চলছে, আমরা ১১ রাকাতে, এমন সময় শুরু হল অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র থেকে বিরতিহীন গুলি! গুলি আসছে পশ্চিম দিক থেকে আর মসজিদের বেড়া বাঁশের, কোন বাঁধা নাই মসজিদের পশ্চিম পাশে। ১১ রাকাতের সেজদায় গেলাম আমরা, কিন্তু ১২ রাকাতে অনেকেই আর উঠে দাঁড়ালো না, আমরা কয়েকজন দাঁড়ালাম কিন্তু সোজা হতে পারছিলাম না। ১২ রাকাত শেষ করে এসএম মুজিব দৌড়ে বের হয়ে গেল, আমরা মসজিদের বারান্দায় বের হয়ে এলাম ক্রল করে বা হামাগুড়ি দিয়ে। আমি আর একটু এগিয়ে ফ্লোর লেভেলে বাইরে রাখা পুরনো সিঁড়ির আড়ালে শুয়ে থাকলাম আর বোঝার চেষ্টা করলাম গুলি কোনদিক থেকে আসছে।
চলন্ত গুলিতে বেলগাছের পাতা ছিঁড়ে যেতে দেখছিলাম। এদিকে উপজেলা কম্পাউন্ড এর নদীর তীর জুড়ে ব্যটালিয়ন সেন্ট্রি পোস্টগুলো থেকে গুলির জবাব যাচ্ছে। গেজেটেড অফিসার্স কোয়ার্টার্স এর ছাদ থেকে যাচ্ছে মেশিনগান এর জবাব। আমি এর আগে কাছ থেকে মেশিনগানের ফায়ারিং সাউন্ড শুনি নাই, ধক-ধক করে যেন ধমক দিচ্ছে অন্যসব স্মল গানসকে। তখনি চোখে পড়ে ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় আমাদের ইমাম, ব্যাটালিয়নের সুবেদার মেজর, হাতে একটি শর্ট ব্যারেল অস্ত্র নিয়ে লেক এর দক্ষিনপাশের রিজ থেকে চিৎকার করে কমান্ড দিয়ে ফায়ার কন্ট্রোল করছে। তাঁর এই অসমসাহসের কথা আমি কখনো ভুলবো না। ইউএনও সাহেবের পরিবার বাসায়, আমি খেয়াল করলাম এতক্ষনের কোন গুলি মসজিদে লেগেছে বলে মনে হচ্ছে না, বেলগাছে লাগছে বা উপর দিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম স্যার, বিল্ডিং এর আড়াল দিয়ে আমরা দৌড়ে বাসায় যাবার চেষ্টা করতে পারি, বাসায় বাচ্চারা আছে। মুক্তিযোদ্ধা ইউএনও মাথা তুলতেই রাজি না!
অন্ততঃ আধ ঘন্টা বা তার কম সময় গুলি বিনিময়ের পর এর তীব্রতা কমতে থাকে। কিছুক্ষণ পর থেমে যায়। একটা সেনা ব্যাটালিয়ন সদরের ওপর এমন হামলা অকল্পনীয়। পরে বোঝা গেল যে এটা ছিল এনগেজমেন্ট এ্যাটাক বা ডাইভারশন এ্যাটাক। পরদিন ভোরেই আমরা জানতে পারি উপজেলা সদরের পূর্বপাশে একটি গ্রামে রাতে শান্তিবাহিনী হানা দেয়, গ্রাম পুড়িয়ে দেয় আর অনেক লোককে মেরে পুড়িয়ে দেয়। সেনাবাহিনী যাবে ঐ গ্রামে, সঙ্গে মৃতদেহ উদ্ধার, সুরতহাল, পোস্টমর্টেম এর ব্যবস্থা ইত্যাদির জন্য আমাকেও যেতে হবে। মনে যত ভয়ই থাকুক, মুখে তো তা বলা যাবে না। আমি সেনাবাহিনী থেকে নিজেকে পৃথক করার জন্য একটা সাদা শার্ট পড়লাম যাতে দূর থেকে বুঝা যায় যে আমি একজন বেসামরিক ব্যক্তি, এরচেয়ে বেশি কিইবা করতে পারতাম। সকাল সকালই হেঁটে রওয়ানা দিলাম, মাইল দু’এক দূরে হবে গ্রামটা, গিয়ে দেখি ভীত সন্ত্রস্ত সব সেটলার্সরা, আমাদেরকে নিয়ে যে বাড়ি গুলোতে মানুষ মেরেছে সেখানে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি পোড়া ঘরের ভেতর পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ।
আমরা উদ্ধার করলাম মোট ১২ জনের পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে একটি মৃতদেহ ময়নাতদন্ত- পোস্টমর্টেম এর জন্য সঙ্গে নিলাম, বাকিগুলো দাফন করতে বলে দিলাম। এরপর নিরাপদেই ফিরে এলাম উপজেলা সদরে। এসে শুনতে পেলাম যে মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং তানাক্যাপাড়াতে শান্তিবাহিনী আরো ২৬ জনকে হত্যা করেছে। ওখানেও সেনা ক্যাম্প, তিনটি বিজিবি ক্যাম্পে রাতে ডাইভারশন এ্যাটাক করে। পরদিন ১ মে ১৯৮৬, সরকারি ছুটি, আর অন্তর্গত উত্তেজনাতো আছেই। আমরা বাস করি সেনাক্যাম্পে, আবার পাহাড়িরাও আছে সবখানেই, পাশের বাসা, উপজেলা চেয়ারম্যান রাজকুমার চাকমা’র। এধরণের সম্পর্ক, এ ধরনের অবস্থায়, মনের উপর যে চাপ পরে তা অবর্ণনীয়। তারওপর আগের ৩৬ ঘন্টার ঘটনা।
সকালের দিকে আমার সোর্স মারফত আমি সংবাদ পাই যে আশেপাশের সেটলার্স বাঙালিরা বিকেলে শান্তি মিছিল বের করবে। আমি বুঝতে পারলাম যে এ ধরনের মিছিল ঝুঁকিপূর্ণ, এতে অবস্থার অবনতিও হতে পারে। আমি যথাযথ স্থানে তা আমার ব্যক্তিগত ক্যাপাসিটিতে জানিয়ে রাখলাম। দুপুরে খাবার পর মানসিক ক্লান্তির কারণেই হয়তো ঘুম আসলো, আমি ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙ্গল একটা অস্বস্তিকর নীরবতায়, একটা ‘আনক্যানি’ অনুভূতি নিয়ে। উঠে দেখি ঘরে ছাই, ঘরে ছাই আসবে কোথা থেকে? বারান্দায় গেলাম, মনে হল দূরে ধোঁয়া উড়ছে। বাসা থেকে বের হয়ে ছাদে গেলাম, দেখলাম দূরে-কাছে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলছে। যা ভয় পেয়েছিলাম তাই ঘটেছে। সেটলার্সরা পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর হামলা করেছে। ঐদিন থেকে পাহাড়িরা আবার ভারত যাত্রা শুরু করলো চেংগী – লোগাং হয়ে। পরদিন উদ্ধারকৃত ১৬টি মৃতদেহ চেংগী নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থেকে দাহ করলাম। এদেরমধ্যে পানছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদের সচিবও ছিল। তার ছেলে ভবতোষ পড়তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, সে চলে গেল শান্তিবাহিনীতে। চলে গেল আমার কোর্ট এর পেশকার, ইউএনও অফিসের সুপার স্নেহময় চাকমা।