মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ হবিগঞ্জ শহর দারুশিল্প ও এ সংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। হবিগঞ্জের দারুশিল্পের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। কিন্তু বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় সংরক্ষণের অভাবে পুরাতন দারুশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। হবিগঞ্জের দারুশিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজমিরীগঞ্জ বিরাট গ্রামের মৃত কামিনা কুমার সূত্রধর, বানিয়াচং উপজেলার ইকরাম গ্রামের মৃত কৃষ্ণমোহন সূত্রধর, দারুশিল্প উদ্যোক্তা মৃত বৈষ্ণব চরণ রায়, ধীরেন্দ্র সূত্রধর, ক্ষেত্রমোহন সূত্রধর, হবিগঞ্জ শহরের ঘাটিয়ার জ্যোতির্ময় দাশ ও সতীশ চন্দ্র সূত্রধর এ শিল্পের মূল কারিগর। মূলত তাদের হাত ধরেই এ শিল্প হবিগঞ্জে বিকাশ লাভ করে। সাম্প্রতিককালে হবিগঞ্জের তরুণ গবেষক ও সাহিত্যিক পার্থ সারথি রায় দারুশিল্প ও শিল্পীদের নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। তার সাথে আলাপকালে জানা যায়, অতীতকাল থেকেই এখানে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় দারুশিল্পীদের একটা শক্তিশালী অবস্থান গড়ে ওঠে। সে ধারাবাহিকতা এখনও বিদ্যমান। তবে বর্তমানে যন্ত্রে নির্মিত কাঠের আসবাবপত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটির দুর্দিন যাচ্ছে। এর শিল্পী এবং নকশাবিদদের সংখ্যাও অনেকটা কমে গেছে। তারপরও শহরে কোনও কারখানায় দৃষ্টিনন্দন দারুশিল্প নিদর্শন সৃষ্টি হতে থাকলে তা নগরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এমনই একটি দৃষ্টিনন্দন পদ্ম-পালঙ্ক তৈরি করেছেন মোঃ লিটন মিয়া নামে এক কারিগর। তার পৈত্রিক বাড়ি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার শাহপুর গ্রামে। হবিগঞ্জ শহরের শ্মশানঘাট এলাকার ‘পাবনাইয়া নকশা ঘর এন্ড ফার্নিচার হাউজ’ নামে তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানে তিনি এটি তৈরীর কাজে হাত দেন। দীর্ঘ সময়ে নির্মীয়মাণ এ পদ্ম-পালঙ্কটি শহরের অনেকেরই দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ পদ্ম পালঙ্কটিতে অঙ্কিত হয়েছে নানা পৌরাণিক ও লোকজ নকশা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা কাঠ খোদাই করে কাজ করে থাকেন তারা নকশা অনুকরণ করে তা করে থাকেন। কিন্তু তিনি কোন নকশা অনুকরণ না করে নিজের চিন্তা চেতনা থেকে পদ্ম পালঙ্কটি সৃষ্টি করেছেন। তার বিশ্বাস এটি তার নিজস্ব সৃষ্টি। আর তাই এ পালঙ্কটি তৈরী করে তিনি মনে এক অন্যরকম অনুভুতি অনুভব করছেন। তিনি বলেন, একটি পালঙ্ক তৈরী করতে প্রায় ৩/৪ মাস সময় লাগে। আর সেটি যদি সেগুণ কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয় তাহলে প্রতিটি পালঙ্ক তৈরীতে ব্যয় হয় প্রায় ৩ লাখ টাকা। আর আকাশমনি কাঠ হলে ব্যয় হয় প্রায় দেড় দুই লাখ টাকা।
এক প্রশ্নে জবাবে তিনি জানান, তার বাড়ি পাবনায়। প্রায় ১৪ বছর আগে তিনি হবিগঞ্জ আসেন। তৎকালীন সময়ে বানিয়াচং উপজেলার মন্দরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ মোঃ শামছুল হক শহরের ঘাটিয়া এলাকায় (সাবেক কৃষি ব্যংক সংলগ্ন) একটি বাসা তৈরী করেন। আর সে বাসার আসবাবপত্র ও দরজা জানালার কাজ করাতে তাবে হবিগঞ্জ নিয়ে আসেন। তিনি তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে সেইযে হবিগঞ্জ এলেন আজও হবিগঞ্জে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। তার অধিকাংশ কাজই মূলত কাঠ খোদাই করে নকশার কাজ। তিনি জানান, শহরের চৌধুরীবাজার কেন্দ্রীয় সুন্নি জামে মসজিদ কমিটির অনুরোধে তিনি মসজিদের দরজা জানালা তৈরীর কাজ করেছেন। প্রথমে তিনি না বললেও মসজিদ কমিটির অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। দীর্ঘ প্রায় দুই বছর কাজ করে তিনি এগুলো নির্মাণ করেন। তিনি যখন শেখ মোঃ শামছুল হকের বাসায় কাজ করতেন তখন শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন তাদের কাজ দেখতে এসে ওই বাসায় ভিড় করতেন।
তিনি আরও জানান, তার দোকানে বর্তমানে ৬ জন কারিগর নিয়মিত নকশার কাজ করছে। এর মধ্যে মোস্তফা নামে একজন রয়েছে যে কথা বলতে পারে না। সে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তার দোকানে কাজ করছে। কাজের প্রতি সে খুবই আন্তরিক। তিনিও মোস্তফার কাজ এবং কর্তব্যনিষ্ঠায় সন্তুষ্ট।
সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্ম পালঙ্কটির মাথার ও পায়ের দিকের দেয়ালসহ চারপাশে কাঠ খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অনাহত চক্র, ফুটন্ত পদ্ম, পরশ পাথর, জোড়া তোতা, মকরের মুখ ও বিভিন্ন লোকজ আল্পনা। পদ্ম-পালঙ্ক এর প্রধান কারিগর মোঃ লিটন মিয়া জানান, দারুশিল্প গবেষক পার্থ সারথি রায়ের উৎসাহে তিনি পদ্ম পালঙ্কের নকশাটি সম্পন্ন করেছেন। পদ্ম-পালঙ্কটি তার নিজস্ব সৃষ্টি। এর আগে কোথাও এমন পালঙ্ক নির্মিত হয়নি। পদ্ম-পালঙ্কটির শিয়রের জমিনের মাঝখানটিতে কাঠখোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন পদ্ম ফুল। এর উপরে রয়েছে দুটি মকরের ঠোঁটের মাঝখানে একটি পদ্মকুঁড়ি। আর এর চারপাশে বিকরিত হচ্ছে সূর্য কিরণ। এর দুপাশে খোদিত আছে দুটি সুদৃশ্য খীলান। খাঠটির খুটিগুলোর মাথায় চৌকো স্থানে খোদিত আছে অনাহত চক্র। মাঝখানে পরশ পাথরের চিহ্ন। খাটটির দুই পাশে রয়েছে জোড়াতোতা। এছাড়াও পদ্ম-পালঙ্কের প্রায় সারাগায়েই নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রতিটি নকশার বিভিন্ন পৌরাণিক ও প্রতীকী অর্থ রয়েছে।
তরুণ গবেষক পার্থ সারথি রায় জানান, অনাহত চক্র হচ্ছে মানবদেহের সাতটি পদ্মচক্রের কেন্দ্রীয় চক্র। এর অবস্থান বুকের মধ্যখানে। শাস্ত্রে আছে অনাহত চক্র মানবমনের কোমলতা, হৃদয়বৃত্তি, সুকুমারবৃত্তি ও সৃজনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনাহত চক্রের সাধনাই মানুষকে হৃদয়বান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। একে কল্পনা করা হয়েছে বারো পাপড়িবিশিষ্ট একটি পদ্মরূপে। আর ফুটন্ত পদ্মফুল হচ্ছে সৌন্দর্য্য ও নিষ্কলুষতার প্রতীক। পদ্মের জন্ম জলে ও কাঁদায়, কিন্তু সে সমস্ত আবর্জনা ও কলুষতা হতে নিজকে বাঁচিয়ে সৌন্দর্য ও পবিত্রতার নমুনা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে।
পরশ পাথর এমন এক বস্তু, যার স্পর্শে সবকিছু স্বর্ণে পরিণত হয়। এর দ্বারা বোঝানো হয় জ্ঞান, নৈতিকতা আর সৌন্দর্যবোধই মানবজীবনের পরশ পাথর। এসবের চর্চায় ও সংস্পর্শে মানুষ সোনার মানুষ তথা প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়।
জোড়া তোতা একটি লোকজ মোটিভ। লোক কাহিনিতে তোতা পাখিকে দেখানো হয়েছে শুভ, অশুভের ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে। আর জোড়া তোতাকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রেম ও মিলনের প্রতীক হিসেবে। তাই যুগ যুগ ধরে বাংলার নারীদের রুমাল ও বালিশের ওয়াড়ের সূচিকর্মে এবং আয়নার উপরের দিকে জোড়া তোতা অঙ্কিত হয়েছে।
মকর একটি পৌরাণিক প্রাণী। দেখতে অনেকটা শুশুকের মতো, পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে মকর গঙ্গার বাহন। এছাড়া মাঘ মাসের সংক্রান্তিকেও মকর সংক্রান্তি বলা হয়। এ দিন থেকেই সূর্য মকরক্রান্তিতে ভ্রমণ বা উত্তরায়ণে গমন শুরু করে। এছাড়াও পদ্ম পালঙ্কটিতে বিভিন্ন আল্পনা, ফুল-লতা পাতাসহ অনেক লোকজ অনুষঙ্গ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় সংরক্ষণের অভাবে পুরাতন দারুশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com