এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জ শহরতলীর তেঘরিয়া গ্রামের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র শিশু ইসমাইল হোসেন বিদয় হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন হয়েছে। বাবার বিদেশ থেকে দেয়া মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়ার জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আর এক মাসের পরিকল্পনায় এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে প্রতিবেশী হবিগঞ্জ জেকেএন্ড এইচকে হাই স্কুল এন্ড কলেজের ৯ম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার মারুফ ওরফে সাইমন। সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নূরুল হুদা চৌধুরীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন তথ্য দিয়েছে গ্রেফতারকৃত সাইমন। সাইমনের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএ-পিপিএম)।
তিনি বলেন, গত ১০ জানুয়ারি উত্তর তেঘরিয়া গ্রামের সৌদি প্রবাসী ফারুক মিয়ার ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ইসমাইল হোসেন বিদয় (১০) পোদ্দারবাড়ি এলাকায় নাটক দেখার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। প্রতিবেশী শাহরিয়ার মারুফ ওরফে সাইমন নাটক দেখানোর জন্য তাকে নিয়ে যায়। কিন্তু রাত ৮টা পর্যন্ত বিদয় বাড়িতে ফিরে না আসায় তার মা বিষয়টি চাচাদের জানিয়ে বিদয়ের সাথে থাকা মোবাইল ফোন নাম্বারে যোগাযোগের জন্য বলেন। বার বার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা বন্ধ পান পরিবারের সদস্যরা। আশপাশে খোঁজাখুজি করে তাকে না পেয়ে মা শাহেনা আক্তার ওই দিন সদর মডেল থানায় এসে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় নিখোঁজের সংবাদও ছাপা হয়। মাইকিং করা হয়। বিদয় নিখোঁজের বিষয়টি থানা পুলিশ তদন্ত অব্যাহত রাখে। বিদয়কে খোঁজাখুজি করা অবস্থায় ১৩ জানুয়ারি সকাল ১০টায় সদর উপজেলার লস্করপুর ইউনিয়নের চরহামুয়া গ্রামের পাশে খোয়াই নদীর কিনারায় পানিতে একটি মৃতদেহ দেখতে পায় স্থানীয়রা। বিষয়টি থানায় অবহিত করলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মোঃ রবিউল ইসলাম (পিপিএম), সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী, পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) দৌস মোহাম্মদসহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পানি থেকে লাশ উদ্ধার করে। পরে নিহতের পরিবারের সদস্যরা মৃতদেহটি ইসমাইল হোসেন বিদয়ের লাশ বলে সনাক্ত করেন। দেখা যায় বিদয়ের মাথায় একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের সদস্যদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে নিহত বিদয়ের চাচা মোঃ টেনু মিয়া ১৪ জানুয়ারি বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলীকে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম (পিপিএম), তদন্তকারী অফিসারসহ পুলিশের একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ১৪ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টায় ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে শাহরিয়ার মারুফ ওরফে সায়মনকে তেঘরিয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। লাশ উদ্ধারের পর থেকে সায়মন নিজেকে আড়াল করে রাখে। আসামীকে গ্রেফতারের পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলামের (পিপিএম) নেতৃত্বে তাকে ঘটনার ব্যাপারে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে। অবশেষে সে বুধবার সন্ধ্যায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
আদালতে সাইমন জানায়, পার্শ্ববর্তী বাড়ির নিহত ইসমাইল হোসেন বিদয়ের হাতে একমাস পূর্বে একটি বিদেশী ক্যামেরা মোবাইল সেট সে দেখে। মোবাইল সেটটি তার বাবা বিদেশ থেকে পাঠিয়েছেন। মোবাইল সেট নিয়ে বিদয় নদীর পাড়ে তার সহপাঠিদের ছবি তোলে। উক্ত মোবাইল সেটের প্রতি আসামী সাইমনের প্রচন্ড লোভ হয়। এ কারনে সে বিদয়ের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলে। একপর্যায়ে ১০ জানুয়ারি বিকেলে সাইমন শহরের পোদ্দারবাড়ি এলাকায় নাটক দেখার জন্য বিদয়কে প্রস্তাব দেয়। বিদয়কে মোবাইল সেট দিয়ে নাটকের ছবি ও ভিডিও করার পরামর্শ দেয়। এতে সে রাজি হয়। সে অনুযায়ী সাইমন বিকেল ৪টার দিকে বিদয়কে নিয়ে রওয়ানা হয়। তারা ধুলিয়াখাল-মিরপুর রোডের মশাজান ব্রিজের পর সিএনজি থেকে নামে। বিদয়কে নিয়ে আসামী সাইমন তার নানা বাড়ি চরহামুয়া নোয়াবাদ যাওয়ার জন্য নদীর বেড়িবাঁধ দিয়ে রওয়ানা হয়। চরহামুয়া গ্রামের নদীর বেড়ি বাঁধে গিয়ে নদীর চড়ে সবজী ও শস্যক্ষেত দেখে গ্রেফতারকৃত সাইমন বিদয়কে নদীর ধারে গিয়ে ছবি তুলতে বললে বিদয় নদীর কিনারায় যায়। নাটকের মতো অভিনয় করে সাইমন কলাগাছের ছোলা দিয়ে বিদয়ের দুই হাত সামনে দিয়ে বাঁধে, পা দুইটিও বাঁধে। সাইমন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ছবি তোলার ভান করে নদীর পাড়ে একটি বাঁশের মোড়া দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে বিদয়ের মাথায় উপর্যুপুরি কয়েকটি বাড়ি মারে। এতে বিদয় মারাত্মক আহত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরে বিদয়কে ধাক্কা মেরে খোঁয়াই নদীর পানিতে ফেলে দ্রুত মোবাইল ফোনটি নিয়ে নিজ বাড়িতে চলে আসে সাইমন।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বলেন, বিদয়ের মোবাইল ফোনটি উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনায় আর কেউ জড়িত আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সাইমন উক্ত হত্যাকান্ডের ঘটনায় এখন অনুতপ্ত। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম পিপিএম, ডিআই-১ কাজী কামাল উদ্দিন, সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী, কোর্ট ইন্সপেক্টর আল আমিন, এসআই মোঃ সাহিদ মিয়া প্রমূখ।
গ্রেফতারকৃত প্রতিবেশী কিশোরের স্বীকারোক্তি
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com