যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় উৎপাদিত পোনা বিক্রিতে সমস্যা হয়। তাই তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে

এস এম সুরুজ আলী ॥ আজমিরীগঞ্জের শিবপাশা হাওরে আমন ধানের জমিতে মৎস্য খামার করে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন খালেদ হোসেন চৌধুরী। তিনি খামারে মাছের পাশাপাশি গরু, হাঁস, দেশী মোরগ ও টার্কি মোরগ পালন করছেন। খালেদ হোসেন চৌধুরীর সফলতা দেখে এলাকার অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক মৎস্য খামার করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। তবে উন্নত যোগাযোগ মাধ্যম না থাকায় খামারে মাছের খাবার সরবরাহ করাসহ রেনু পোনা আমদানি ও রপ্তানী করতে অসুবিধার সম্মুখিন হচ্ছেন খামারীরা। খালেদ হোসেন চৌধুরী জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরো উন্নতভাবে মাছের চাষ করতে পারতেন তিনি। শুধু মাছ চাষ নয়, তিনি মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন করেন। তার হ্যাচারীতে সপ্তাহের ৪ দিন পোনা উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন ১ লাখ মনোসেক্স তেলাপিয়ার রেনু পোনা উৎপাদন করা যায়। ১ লাখ পোনা মাছ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না থাকায় উৎপাদিত পোনা বিক্রিতে সমস্যা হয়। তাই তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি তার খামারে যাওয়ার রাস্তাটিতে ৯ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে তিনি আবারও তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন কার্যক্রম চালু করার স্বপ্ন দেখছেন। খামারী খালেদ হোসেন চৌধুরীর সফলতা দেখে এলাকার অনেক বেকার যুবক ও কৃষক এ পেশায় এগিয়ে আসছেন। অপরদিকে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, চলচ্চিত্র ও নাট্য অভিনেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন খালেদ চৌধুরীর খামার পরিদর্শন করতে আসছেন। কেউ হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য উপভোগ করছেন, আবার কেউ পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করছেন।
সরেজমিনে আজমিরীগঞ্জের শিবপাশায় খালেদ হোসেন চৌধুরীর খামারে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল এলাকা জুড়ে ১৪টি পুকুর নিয়ে গড়ে উঠেছে এমএজি এগ্রো ফার্ম লিঃ। খামারের পুকুরের চার পাড়ে পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। সেগুলো পরিদর্শনকারীদের দৃৃষ্টি আকর্ষণ করছে। খামারে শুকনো মৌসুমে মোটর সাইকেল কিংবা অন্যান্য পরিবহন নিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারলেও বর্ষা মৌসুমে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। বর্ষা মৌসুমে খামারে মাছের খাদ্য নৌকা দিয়ে নিয়ে যেতে হয়। ভাল যোগাযোগ মাধ্যম না থাকায় মালিক পক্ষকে অনেক কষ্টে খামারে খাদ্য নিয়ে যেতে হয়।
খালেদ চৌধুরী জানান, তার পৈত্রিক অনেক জমি-জমা রয়েছে। এক সময় তাদের পরিবার জমি চাষ করেই মূলত জীবিকা নির্বাহ করতেন। জমিগুলো চাষ করে যে ধান উৎপাদন হয়, উৎপাদিত সেই ধানের টাকায় সংসারের খরচ চালনোই কঠিন হয়ে পড়ে। এক সময় তিনি চিন্তা করতে থাকেন ধান চাষের চেয়ে জমিগুলোতে কি চাষ করলে বেশি লাভ হবে। সেই পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এগিয়ে যান। ২০১৪ সালে তৎকালীন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিনের পরামর্শে তিনি প্রায় ৩২ একর জমির মধ্যে পুকুর খনন করেন। পুকুরগুলো খননের সময় জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। সঠিক মাপ অনুযায়ী কয়েকটি পুকুর খনন করে তিনি মাছ চাষ শুরু করেন। খামারে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন খালেদ হোসেন চৌধুরী ছোট ভাই সেজাউল হোসেন চৌধুরী। খামারে ১৪ জন শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন।
খালেদ হোসেন চৌধুরী আরও জানান, মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের পোনা উৎপাদন হওয়ার পর পরই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। শুধু পোনা মাছ নয়, পুকুরে চাষকৃত মাছ হবিগঞ্জের বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এতে মানুষের মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ার কারণে চাহিদা মাফিক মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, শুরুর দিকে খামারে পুকুর খননসহ সব মিলিয়ে ১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ২ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি সহযোগিতা আছে ২৩ লাখ টাকা। অন্যান্য টাকা পারিবারিক খাত ও বর্তমানে লাভের অংশ থেকে ব্যয় করা হয়েছে। খামারের মাছ বড় হয়েছে। কিছুদিন পর যখন হাওরে দেশী মাছ থাকবে না, তখন বাজারে সেই মাছ বিক্রি করা হবে। খামারে আসা যাওয়ার রাস্তা উন্নয়নসহ সরকারি আরো সহযোগিতা পেলে খামারটি আরো উন্নত মানের খামার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হতো বলে তিনি মনে করেন। এ জন্য তিনি সরকারের সহযোগিতা কামনা কামনা করেন।
তিনি বলেন, হাওর অঞ্চলে তার খামারটি সৌন্দর্য্য ছড়াচ্ছে। সেই সৌন্দর্য্য দেখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ সেখানে ঘুরতে যায়। এর মধ্যে অনেকেই শখের বশে পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করেন।
এমএজি এগ্রো ফার্ম লিঃ এর ম্যানেজার সুমন মিয়া জানান, আমরা মাছ চাষের পাশাপাশি গরু ও ভেড়ার খামার করেছি। পাশাপাশি দেশী মোরগ, টার্কি মোরগ লালন পালন করছি। মাছের ন্যায় সেগুলোতে লাভবান হচ্ছি। আমাদের এই খামার দেখে এলাকার অনেকেই খামার করতে আগ্রহী হচ্ছেন। তিনি খামার করতে উৎসাহীদের উন্নত প্রশিক্ষণসহ সরকারি সহযোগিতা প্রদানের দাবি জানান।
সম্প্রতি এমএজি এগ্রো ফার্ম লিঃ পরিদর্শন করতে আসেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী একেএম খালেদ এর বড় ভাই বিশিষ্ট চলচ্চিত্র অভিনেতা মাহ্মুদ সাজ্জাদ। তিনি বলেন, খালেদ হোসেন চৌধুরীর খামারে শখের বশে মাছ শিকার করতে এসেছিলাম। এখানে এসে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেছে। খুব চৎমকার জায়গা। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হলে এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতো। আমি সরকারের কাছে এই অঞ্চলের রাস্তাঘাট উন্নত করার দাবি জানাই।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ শাহজাদা খসরু জানান, এক সময় আজমিরীগঞ্জ মাছের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। খাল-বিল, জলাশয় ভরাট হওয়ার কারণে আগের তুলনায় মাছ উৎপাদন হচ্ছে না। খালেদ হোসেন চৌধুরী সেখানে হ্যাচারীর মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করছেন। তার মত হ্যাচারী বৃহত্তর সিলেটে ২/৩টি রয়েছে। আজমিরীগঞ্জে আরো কিছু ছোট ছোট মৎস্য খাবার রয়েছে। সেখানেও মাছের উৎপাদন হচ্ছে। খালেদ হোসেনসহ মৎস্য খামারীদের সকল ধরণের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। খালেদ হোসেন অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন করে যাচ্ছেন, তাকেও আমরা সহযোগিতা করছি।
এলাকাবাসী জানান, খালেদ হোসেন চৌধুরী ফিসারী করে যেভাবে উন্নতির দিকে যাচ্ছেন। তার দেখাদেখি এখন এলাকার অনেক মানুষ এ ধরণের হ্যাচারী করতে আগ্রহী হয়েছেন।