স্টাফ রিপোর্টার ॥ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় টগবগে তরুণ মোহাম্মদ আলী টিপু ছিলেন ছাত্র। তার পিতা অ্যাডভোকেট মোস্তফা আলী এমপি এবং মহুকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে হবিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করতে বলিষ্ট নেতৃত্ব দেন। ছিলেন সর্ব দলীয় সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক। পিতার আদর্শ ও পদাঙ্ক অনুসরণ করে মোহাম্মদ আলী টিপু সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ভূমিকা রাখাসহ মুক্তিযুদ্ধে নেমে পড়েন অস্ত্র হাতে।
যুদ্ধ শুরু হলে ৩নং সেক্টরের ২২নং সাব সেক্টর ইকোর এই যোদ্ধা ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদের নেতৃত্বে। ২শ’ এর অধিক গেরিলা নিয়ে যে কোম্পানী গঠন করা হয় তিনি ছিলেন সেই কোম্পানীর কমান্ডার। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই মহকুমা থেকে তিনি যুদ্ধে অংশ নিতেন। যুদ্ধের স্মৃতির কথা জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী টিপু বলেন, যুদ্ধের বর্ণনা আর গল্প করার জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি। এরপর তিনি কয়েকটি অপারেশনের কথা বলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চুনারুঘাট উপজেলার কালেঙ্গা অ্যাম্বুশের কথা। সেই অ্যাম্বুশে ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বাধীন টিমসহ একাধিক টিম অংশগ্রহণ করলেও এই অ্যাম্বুশে আমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি। ক্যাপ্টেন এজাজ এবং ক্যাপ্টেন আজিজ এখনও জীবিত আছেন। তারা সব জানেন। ১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেই অ্যাম্বুশে একজন অফিসার এবং ৬১ জন পাকিস্তানী সেনাকে আমরা হত্যা করি। যদিও সামান্য ভুলের জন্য আব্দুল মান্নান নামে আমাদের এক সৈনিককে সেদিন প্রাণ দিতে হয়েছিল।
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমাকে আমার লিডার ক্যাপ্টেন এজাজ দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন রশিদপুর চা বাগানের ফ্যাক্টরী ধ্বংস করার জন্য। দেয়া হয়েছিল ফায়ার গ্রেনেড। কিন্তু মন চায়নি। কারণ আমার বাবা মরহুম মোস্তফা আলী ছিলেন এমএনএ। তার কাছ থেকেসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বুঝতে পারছিলাম আমরা স্বাধীন হয়ে যাব। তখন চিন্তা করি আমাদের এত বড় সম্পদ নষ্ট করে কি লাভ। ’ আমি সেটি উড়িয়ে না দেয়ায় ক্যাপ্টেন এজাজ আমাকে বলেন ‘এটি কি তোমার বাবার সম্পদ? তুমি কেন সেটি ধ্বংস করলা না’। আমি যদি সেদিন সেটি ধ্বংস করতাম তাহলে হয়তোবা কোন পদক পেতাম। ফয়জাবাদ বধ্যভূমিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ৯ এপ্রিলের পর থেকে গণহত্যা চালায় বলে জানান তিনি।
মোহাম্মদ আলী টিপু তার বাহুবলের আরেকটি অপারেশনের কথা উল্লেখ করেন। সেটি হল রশিদপুর চা বাগানের চা শ্রমিক নেতা রাধা ভিম গোয়ালাকে হত্যার কথা। তিনি বলেন ‘রাধা ভিম গোয়ালা মুক্তি বাহিনীর সা সে তাদেরকে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করত। হবিগঞ্জের শান্তি কমিটির নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল্লার সোর্স ছিল সে। তাই তাকে আমি ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করি। ’
রশিদপুর এলাকায় মোহাম্মদ আলী টিপু ছিলেন একজন ত্রাস। তাই ফয়জাবাদ পাহাড়ের আমতলি চা বাগানের একটি টিলার নামকরণ করা হয়েছিল টিপু টিলা। যা আজও তার নামে আছে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম জানে না সেই ইতিহাস। বাহুবল মুক্ত করতে এবং সেদিক দিয়ে মাহবুবুর রব সাদীসহ বিভিন্ন গ্রুপের অভিযানের সুযোগ করে দিয়েছিলেন সেই টিপু।
মোহাম্মদ আলী টিপু ছিলেন প্রচার বিমুখ মানুষ। বড় নেতৃত্ব পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তার প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। তার পিতা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এমপি ও পরে জেলার গভর্ণর ছিলেন। তিনি নিজে জেলা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করলেও নেননি বড় পদ। পরবর্তীতে সকল আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থাকলেও বড় পদের প্রতি তিনি কোন সময় লালায়িত ছিলেন না।
কালেরকণ্ঠের ১০ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে মোহাম্মদ আলী টিপুকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। একটি উত্তরীয়, ক্রেস্ট আর নগদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। এই সম্মাননা পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত। এই পুরস্কারকে তিনি উৎসর্গ করেছেন হবিগঞ্জের সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। আর কালেরকণ্ঠ সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানিত করায় সেই পত্রিকাকেও ধন্যবাদ জানান তিনি। সম্প্রতি তিনি স্ত্রীকে হারিয়েছেন। তার দুই সন্তান। একমাত্র মেয়ে নরসিংদীতে সহকারী কমিশনার ভূমি হিসেবে কর্মরত আর ছেলে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে শ্রীমঙ্গলে বিটিআরআইতে কর্মরত। সন্তানের এই সফলতা তাকে আনন্দ দেয়।