তাহমিনা বেগম গিনি
আমার ছোট ছেলে ডাঃ ছোটনের খুব ইচ্ছে ছিল বুয়েটে পড়বে। কিন্ত সে ভর্তির পরীক্ষায় সুযোগ পায়নি। মোটামুটি মেধাবী সে। তাকে বলেছিলাম অন্য কোথাও ভর্তি হতে, কিন্ত না সে বুয়েটে যখন ভর্তি হতে পারেনি আর কোথাও প্রকৌশলী হবে না। বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই ঘরে ঘরে ছেলে মেয়েগুলো বড় হয়ে উঠে। যখন শুনি অমুুকের ছেলে, বা মেয়ে বুয়েট, ঢাকা মেডিকেলে সুযোগ পেয়েছে, সবাই ধরে নেই বাচ্চাটি অবশ্যই মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াশোনা করেছি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েছেন তারাও নিজেদের অনেক মেধাবী এবং গর্বিত মনে করেন। এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেকের স্বপ্নপূরনের স্থান। আমি যখন পড়েছি সেই সত্তর দশকেও বুয়েট, মেডিকেল ছিল। সে সময়ের পড়াশোনা, পরিবেশ, রাজনীতি, শিক্ষকছাত্র সর্ম্পক, ভিন্ন ভিন্ন দলমত, আবাসিক হোস্টেলের পরিবেশ, সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্ক সবই এখনকার ছেলে মেয়েদের কাছে রুপকথার মত মনে হবে। এই ষাটোর্ধ্ব বয়সে এসেও মনে হয় কত সুন্দর সময় কাটিয়ে এসেছি। এ সব অন্য একদিন লিখবো। আজ-কালকার মা, বাবাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকে কিভাবে তাদের ছেলে মেয়েদের একটি ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ¯œাতক শ্রেণীর জন্য ভর্তি করবেন। সবারই উদ্দেশ্য থাকে পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর। প্রথমত অর্থনৈতিক সমস্যা, দ্বিতীয়ত এবং প্রধানত মেধাবীরাই এখানে সুযোগ পায়। বাংলাদেশে এখন অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আছে এবং কোন কোনটি অনেক ভালো মানের। সে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাবার টাকা থাকলেও ভর্তি হওয়া যায় না যোগ্যতা ছাড়া। তারপরও যে কোন প্রাইভেট মেডিকেল, প্রকৌশল, বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তি করাতে পিতা মাতাকে অনেক টাকা গুনতে হয়। তাই যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ভর্তি হতে পারেন তারা এবং তাদের পিতা মাতা নিজেদের অনেক ভাগ্যবান মনে করেন। গত দুই তিনদিন যাবত বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, ফেইসবুক এবং টেলিমিডিয়া যারা নিয়মিত দেখছেন, পড়ছেন তাদের কারও সন্তান যদি বুয়েটে পড়ে থাকেন সে সব পিতামাতার মনের অবস্থা এখন কেমন আছে জানিনা। বিশেষ করে র্যাগিং, ভিন্ন ভিন্ন মতের জন্য নিয়মিত শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের যেসব ভয়াবহ, ভয়ংকর ঘটনা এখন বেরিয়ে আসছে এসব জানার পর উনাদের মানসিক অবস্থা সুস্থ থাকার কথা নয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সবসময় মনে করতাম বুয়েট সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ অন্য রকম। ভাবনায় ছিল এখানে সবচেয়ে ভালো শিক্ষার পরিবেশ বিদ্যমান। একজন আবরার ফাহাদের মৃত্যু কত কিছুই জানিয়ে গেল আমাদের। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোয় খুন হয়েছেন ১৫১ জন শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে- খুন হয়েছেন অন্তত ৭৪ জন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, চট্রগ্রামে খুন হয়েছেন ১৯, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ জন, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে ২ জন, হযরত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ জন করে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এইসব হত্যার ঘটনায় কোন অপরাধী শাস্তির মুখোমুখি আজও হয়নি। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ পড়ে, রক্ত ঝড়ে, কিছুদিন পর ধামাচাপা পড়ে যায়। আবরার হত্যাকান্ড অনেক অজানা বিষয় দেশসহ আর্ন্তজাতিক অঙ্গনের চোখ খুলে দিয়েছে। বুয়েট একটি অহংকারের নাম। সারা দেশের মেধাবীদের একটি অংশ এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। আবরারকে হত্যা করা হয়েছে স্বাধীন চিন্তার কারনে। বাংলাদেশ ভারতের সাম্প্রতিক চুক্তির সমালোচনা করে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস তার হত্যার কারণ বলে এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে। আততায়ীরা মনে করেছিল সে শিবিরের সমর্থক। অথচ তার দাদার সময় থেকেই তারা আওয়ামী ঘরানার। কে কোন দলের সমর্থক সেটা মূখ্য নয়, আমি বলবো আবরার দেশটাকে ভালবেসেছিল। যদিও দেশকে ভালবাসা এখন অনেক সময় ক্ষেত্র বিশেষে কঠিন অপরাধ। এই হত্যাকান্ডে প্রমাণিত হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা গর্হিত অপরাধ। অথচ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আমরা জানতাম স্বাধীন চিন্তার সুতিকাগার। যুক্তি তর্ক দিয়ে বির্তক হওয়ার কথা যেখানে, সেখানে হচ্ছে শক্তি প্রদর্শন। ফলে ঘটে চলেছে অস্বাভাবিক মৃত্যু। আবরারের হত্যাকারীদের পরিচয় বিভিন্ন ভাবে এসেছে। দেখা গিয়েছে বিভিন্ন অস্বচ্ছল পরিবার থেকে তারা এসেছেন। জীবনে রাজনীতির সাথে পরিচয় ছিলনা। বুয়েটে ভর্তির আগে তারা সবাই ন¤্র, ভদ্র, মেধাবী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। আজ তাদের এই ভয়ংকর, হত্যাকারী, খুনি চেহারার মাঝে আত্মীয়, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী, বন্ধুরা সেই ন¤্র ভদ্র ছেলেগুলোকে খুঁজে ফিরছেন তন্ন তন্ন করে। তাই দুঃখ শুধু আবরারের জন্য নয়, দুঃখ হয় হত্যাকারীদের জন্যও। বুয়েট কি তাদের প্রকৌশলী বানাবার পরিবর্তে খুনি বানিয়ে দিল? তারাও মেধাবী, তাদের মা বাবার কত স্বপ্ন ছিল? তারা হয়তো আর ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। এখন তারা ক্রিমিনাল। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান তাদের ক্রিমিনাল বানিয়েছে। যখন এই লেখাটা লিখছি তখন বুয়েটে আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত। ৫ দফা দাবি বুয়েট প্রশাসন মেনে নিয়েছেন। সামনে ভর্তি পরীক্ষা। পিতা-মাতা এবার মানসিক ভাবে পর্যুদস্থ কারণ -র্যাগিং। র্যাগিং এর যেসব ভয়াবহতা সামনে এসেছে- কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ ঘটনা ঘটতে পারে ভাবা যায় না। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই এসব ঘটে চলছে বর্তমানে। আমি বলবো এসব একেবারে বন্ধ হোক। চাইনা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ নং নামক কোন কক্ষ থাকুক। আশার কথা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরত্ব দিয়েছেন। হত্যাকারী ছেলেগুলোকে দল এবং বুয়েট থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করার সিন্ধান্ত নিলে জনমনে স্বস্থি আসবে এবং বিচারে শুধু রায় হলে হবে না, বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনের জন্য যথাসম্ভব রায় তাড়াতাড়ি কার্যকর করা দরকার। নইলে আবরারের মার কথাই সঠিক হবে- ‘আমি রাষ্ট্রের কাছে কোন বিচার চাইনা, আল্লাহই বিচার করবেন’। সকল ছাত্রের মা-ই আল্লাহর কাছে হাত তুলে আজও কেঁদে চলেছেন। ছোট বেলা থেকেই একটি কথা শুনে আসছি- আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। আর আজ শুনছি ‘আমার ছেলে যেন অপঘাতে না মরে’। আমাদের দেশটাকে অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি। যারা রক্ত ঝড়িয়েছিলেন তারা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছিলেন। যেখানে দল মত, ধর্ম সবকিছুর স্বাধীনতা থাকবে। নারী, শিশু, যুবক, যুবতী, বৃদ্ধ সবাই নিরাপদ থাকবেন। বাংলাদেশে কোন ২০১১ নং কক্ষ থাকবে না।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com