মনসুর আহমেদ
মানুষে মারে মানুষ
মানুষেই করে তার বিচার,
মানুষের খাঁচায় মানুষ বন্দী
মানুষই তার পাহারাদার।
–তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল
(জন্ম: ১৪ এপ্রিল ১৯৫১ – মৃত্যু: ৩ ডিসেম্বর ২০১৩)

শখের বসে গল্প, কবিতা, নাটক লেখার চেষ্টা করা যায় কিন্তু গবেষণার কাজ করা যায় না। স্কুল জীবনেই শখের কাজটা সেরে ফেলেছেন তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল। মঞ্চ নাটক লেখা এবং অভিনয়ে অনেক পারদর্শী ছিলেন তিনি। ছাত্র জীবনেই সহপাঠীদের নিয়ে গড়ে তুলেন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নবারুণ কৃষ্ঠি সংসদ’। এই সংগঠন থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘নবারুণ’ সম্পাদনা করেছেন নিয়মিত। একজন দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিতি ঘটে হবিগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দানকারী কবি দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা, অধ্যাপক নিখিল ভট্টাচার্য, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, সৈয়দ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, কবি পার্থ সারথি চৌধুরী প্রমুখ সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিবর্গের সাথে।
গানের প্রতি খুব বেশী আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ছাত্র জীবনেই সাথে রেডিও নিয়ে ঘুর বেড়াতেন, গান শোনার জন্য প্রতিনিয়ত উনার মনের পিঞ্জিরা ছটফট করতো। স্থানীয় সুরবিতানে উস্তাদ মোঃ বাবর আলী খানের কন্ঠে প্রায়ই শুনতেন আধ্যাত্মিক গান, আর এই গানই উনাকে লোকসাহিত্যের ফেরিওয়ালা বানিয়ে দেয়। ছুটে চলেন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হবিগঞ্জ জেলার গ্রামে-গঞ্জে, সংগ্রহ করেন মরমীকবি ও সাধকদের লেখা কালজয়ী সৃষ্টি। আর সবাইকে এক মলাটে আবদ্ধ করেন উনার প্রথম সম্পাদিত “হবিগঞ্জের মরমী সাধক” গ্রন্থে। এই গ্রন্থে হবিগঞ্জ জেলার বিশজন সাধকের সৃষ্টি ও জীবন বৃত্তান্ত খোলাসা করে প্রকাশ করেন।
হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার ভাদিকারা গ্রামের মরমী সাধক ও পুথি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ শেখ ভানু’র জনপ্রিয় গান “নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা, নিশীথে যাইও ফুলবনে” গানটি কখনও রাধারমণ দত্ত ও পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এর রচিত হিসেবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল সব মতানৈক্যের ভেদ ভেঙে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন এই গানের মূল ¯্রষ্টা উনিশ শতকের ক্ষণজন্মা মরমী দার্শনিক গীতিকবি শেখ ভানু শাহ। সদাহাস্যজ্বল ও পরিশ্রমী লোক গবেষক হিসেবে উনার উপস্থিতি ছিল সরব।
তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল ১৯৫১ সালে হবিগঞ্জ জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের দৃষ্টিনন্দন চুনারুঘাট উপজেলার দেউল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী তরফদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুহাম্মদ ইসহাক তরফদার, মাতা সৈয়দা ছালেমা খাতুন। স্থায়ীভাবে হবিগঞ্জ শহরের রাজনগরে বসবাসকারী তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন স্কুল শাখার সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন এবং বৃন্দাবন সরকারি কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৬৯-৭০ সালে কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পাক-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং সামরিক আইনের অধীনে গ্রেফতার হয়ে হবিগঞ্জ ও সিলেট কারাগারে একমাস ছয়দিন কারাভোগ করেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে বিজয়ের ফলে এক সরকারি ফরমানে সিলেট কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে স্নাতক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কর্মজীবনে ছিলেন খাদ্য অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক। এখানেও অনেক দক্ষতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন।
সংসার, পরিবার, পরিজন নিয়ে সুখী সমৃদ্ধ তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল লোকসাহিত্যকে আত্মস্থ করেছেন পরম যতœ সহকারে। একটি অঞ্চলের লোক ইতিহাস ঐতিহ্যকে জাতীয়ভাবে উপস্থাপন করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আর এই সব কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় জাতীয় পরিমন্ডলে লোকসাহিত্যকে যাঁরা আগলে রেখেছেন সেই সব কিংবদন্তিদের সাথে। লোকগবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী, দেওয়ান নুরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, লোকসংঙ্গীত শিল্পী মুস্তফা জামান আব্বাসী, অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকার, অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদ্দর আলী, অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা প্রমুখ শ্রদ্ধাভাজনদের সাথে। উনাদের অনেক এর সাথেই লোকসাহিত্য নিয়ে মাঠে ময়দানে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। মুস্তফা জামান আব্বাসী’র উপস্থাপনায় বাংলাদেশ টেলিভিশন এর একসময়ের জনপ্রিয় লোকসাহিত্যের অনুষ্ঠান ‘ভরা নদীর বাঁকে’ একজন তথ্য সংগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন।
তিনি ১৯৭২ সালের প্রতিষ্ঠিত হবিগঞ্জ সঙ্গীত বিদ্যালয়ের (সুরবিতান) প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হবিগঞ্জ সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক পরবর্তীতে প্রায় ছয় বৎসর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে হবিগঞ্জের সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের সবাইকে এক করে বিষয় ভিত্তিক মাসিক সাহিত্য আড্ডা আয়োজন করতে বাইসাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন শহরে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। হবিগঞ্জ পৌরসভা ও জেলা প্রশাসক কর্তৃক আয়োজিত বই মেলায় বিশাল বইয়ের সম্ভার নিয়ে অংশগ্রহণ করতেন একজন তরুণের মত। চাকুরী থেকে অবসরের পরে লোকসাহিত্যকে প্রাধান্য দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তুলেন একটি লাইব্রেরি।
উনার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘হবিগঞ্জের মরমী সাধক’ (১৯৮৯), ‘হবিগঞ্জের পুঁথি সাহিত্য’ (১৯৯৮), ‘ভাষা আন্দোলনে হবিগঞ্জ’ (২০০০), ‘সুফি দার্শনিক কবি শেখ ভানু’ (২০০৪), ‘অধীন শেখ ভানু বলে’ (২০০৫)। সম্পাদনা গ্রন্থ ‘হবিগঞ্জ পরিক্রমা’ (যৌথ ১৯৯৪), ‘রক্তধ্বনি’ (১৯৯৪), ‘বিজয়কন্ঠ’ (১৯৯৪), ‘একুশিকা’ (১৯৯৬) ‘সুপঞ্চমী’ (১৯৯৭), উস্তাদ বাবার আলী খান স্মারক গ্রন্থ (২০০৮) বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’ (২০১৩) প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অপ্রকাশিত গ্রন্থ ‘আমার জেলা হবিগঞ্জ’ (গবেষণা গ্রন্থ), ‘খোয়াইপাড়ের কিসসা’ (গবেষণা গ্রন্থ), ‘মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ’ (গবেষণা গ্রন্থ)। উনার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন মুখি কাজের অবদানের জন্য পেয়েছেন বেশকিছু সম্মাননা পদক।
২০১৩ সালের ৩ ডিসেম্বর লোকসাহিত্যের গবেষক তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। একজন গবেষক হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। আপনার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখকঃ কবি ও প্রাবন্ধিক
সম্পাদক, ‘শব্দকথা’
রামকৃষ্ণ মিশন রোড, হবিগঞ্জ।
মোবাইল- ০১৭৬৫২৭৯৯৯০