স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের দুর্নীতি তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য নিশ্চিত করেন হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাঃ একেএম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের দুর্নীতি তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল হাসান জানান, মেডিকেল কলেজের দুর্নীতি তদন্তের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে শুনেছি। তদন্ত করেই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে মেডিকেল কলেজের টেন্ডার দুর্নীতির সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির। তিনি গতকাল তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন- বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের টেন্ডার দুর্নীতি নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা আমাদের নজরে এসেছে। সাংবাদিকদেরকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি সংবাদ তোলে আনার জন্য। তিনি আরো বলেন- আমাদের গর্বের প্রতীক উক্ত মেডিকেল কলেজে টেন্ডার দুর্নীতির সাথে যে বা যারা জড়িত, তদন্তের মাধ্যমে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হবে।
অপরদিকে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের পাতানো দরপত্রে অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেছে বাজার দর নির্ধারণ কমিটি। বাজার দর নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ও কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ মোঃ শাহীন ভূইয়া গণমাধ্যমকে জানান, ‘বাজার দর নির্ধারণের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়নি। তাই স্বল্প সময়ের মধ্যে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই সম্ভব হয়নি। যে কারণে কিছু অনিয়ম থেকে যেতে পারে’। তবে তিনি নিজের দায় এড়িয়ে বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত নই’।
‘শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ’র দরপত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। সচেতন মহলসহ সাধারণ নাগরিকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন তীব্র প্রতিক্রিয়া। ফেসবুক স্ট্যাটাসে অনেকেই দুর্নীতির সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
দুপুরে সরেজমিনে বিষয়টির খোঁজ-খবর নিতে কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে কয়েকজন প্রভাষক ছাড়া আর কাউকেই পাওয়া যায়নি। যারা আছেন তাদের কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। অনেক পীড়াপীড়ির পর বাজারদর নির্ধারণ কমিটির সভাপতি ডাঃ মোঃ শাহীন ভূইয়া মুখ খুললেও দুর্নীতির দায় নিজের কাঁধে নিতে চাননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বইপত্র, সাময়িকী, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য ২০১৮ সালে দরপত্র আহবান করা হয়। এ লক্ষ্যে কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত আদেশে ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডাঃ মোঃ শাহীন ভূইয়াকে সভাপতি করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট বাজার দর যাচাই বাছাই কমিটি গঠন করা হয়। দরপত্রে অংশ নেয় ৭টি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মূল্যায়ন রিপোর্টে সদস্যদের স্বাক্ষর ছাড়াই ঢাকার শ্যামলী এলাকার বিশ্বাস কুঞ্জছোঁয়া ভবনের ‘নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ’ ও মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে মালামাল সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ৯৭ হাজার ৭৪৮ টাকা। মালামাল ক্রয় বাবত ব্যয় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১০৯ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি নয়, এমনটাই বলছে দরপত্র প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। বাকি টাকার পুরোটাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে।
সূত্র মতে, সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোর আই ফাইভ, কিং জেনারেশন) মূল্য নেয়া হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ’ টাকা। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা। অথচ ঢাকার কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ফ্লোরায় একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। ৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টার (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ)-এর দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ’ টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। জনপ্রতি চেয়ার-টেবিল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যয় পড়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ টাকা। চেয়ারগুলোতে ‘ইয়ামিন ফার্নিচার’ লেখা থাকলেও টেবিলগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের এর কোনো স্টিকার লাগানো নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এসব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত সাধারণ মানের ১৫টি বুক সেলফের মূল্য ৬ লাখ ৬০ হাজার, ৫টি স্টিলের আলমিরা ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেট ৪ লাখ ২২ হাজার, ২৫টি স্টিলের র্যাক ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ও ৬ হাজার ৪৭৫টি বইয়ের জন্য বিলে দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টাকা। এছাড়াও বিলে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিক মডেলের মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা দেখানোসহ দেশের বাজারে ‘পেডিয়াটিক সার্জারি’ (২ ভলিয়মের সেট) বইটির দাম ৩৩ হাজার টাকা হলেও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম নিয়েছে ৭০ হাজার ৫৫০ টাকা।
এদিকে, মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। যার মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩২৫ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩শ’ টাকা। পুনম ইন্টারন্যাশনাল এসি’র দাম ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টির মূল্য নিয়েছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩৯০ টাকা, একই কোম্পানি ও একই মডেলের ফ্রিজের মূল্য গুনতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এ রকম ৬টি ফ্রিজ কেনা হয়। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওয়েইং (ওজন মাপার যন্ত্র) মেশিনের দাম নেয়া হয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাস্তবে যার বাজার মূল্য ৪০ হাজার টাকা করে। এছাড়া মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ছবি সম্বলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় পাওয়া গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮শ’ টাকা দরে। এ রকম ৪৫০টি চার্ট ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ৩৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। দেশে ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকায় পাওয়া যায় ‘স্টারবোর্ড‘ নামে হিটাচি কোম্পানির ৭৯ ইঞ্চির ইন্টারেক্টিভ বোর্ড। কিন্তু একই কোম্পানি ও মডেলের এই ইন্টারেক্টিভ বোর্ডটি কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। এ যেন এক তুঘলকি কান্ড।
ওই সব মালামালের বাড়তি দাম নিয়ে কানাঘুষা আছে খোদ কলেজেই। কলেজের দু’জন শিক্ষক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘যেসব বই কেনা হয়েছে এর কিছু বই এমবিবিএস ক্লাসের ছাত্রদের কোনো কাজে লাগবে না। কারণ এসব বই গবেষণার কাজে লাগে’। তারা বলেন, ‘শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এখন ৩য় বর্ষে পদার্পণ করেছে। আগামী ২০২২ সালে তারা ৫ম বর্ষে পৌঁছাবেন। কিন্তু ২০১৮ সালে ৫ম বর্ষে পড়ানোর জন্য বই কিনতে হবে এর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন সংস্করণের বই থেকে বঞ্চিত হবে’।
এ বিষয়ে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ মোঃ আবু সুফিয়ানের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘সরকারী ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করে বাজারদর যাচাই-বাছাই কমিটি সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডারে কাজ দেয়া হয়েছে। এখানে কোন প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি হয়নি’।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় ও হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি মোঃ আবু জাহিরের প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি কলেজটি অনুমোদন লাভ করে। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কলেজটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com