হবিগঞ্জের মুখ রিপোর্ট ॥ সৌদি আরবে নিয়োগকর্তার নির্যাতনের শিকার হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার হুসনা আক্তারকে (২৪) উদ্ধার করা হয়েছে। মধ্যরাতে এক বার্তায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সৌদি আরবের নাজরান এলাকায় একটি বাড়ি থেকে ভিডিও বার্তায় দেশে ফেরার আকুতি জানানো গৃহকর্মী হুসনে আক্তারকে উদ্ধার করে হেফাজতে নিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। যা জেদ্দা থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে। গত রোববার দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকায় ‘সৌদি থেকে আজমিরীগঞ্জের হুসনার ভিডিও বার্তা, ‘আমি আর পারতাছি না, আমারে বাঁচাও’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এছাড়া তার আকুতির একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। বিষয়টি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের নজরে আসে। তিনি সৌদিতে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেন। ওই নারীর পরিবারের সদস্যদের দাবি অনুযায়ী তাকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে জেদ্দা দূতাবাস ।
উল্লেখ্য, এর আগে পঞ্চগড়ের সুমি আক্তারও সৌদি আরবের নাজরান এলাকায় নির্যাতনের শিকার হয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন। দূতাবাস তাকে উদ্ধার করে। গত ১৫ নভেম্বর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে সরকার।
উল্লেখ্য, ভিডিও বার্তায় হুসনা বলেছিলেন, ‘আমি মোছা. হুসনা আক্তার। আমার দালালে ভালা কথা কইয়া আমারে পাঠাইছে সৌদি। নিজরাল (নাজরান) এলাকায় আমি কাজ করি। আমি আইসা দেখি ভালা না। ওরা আমার উপর অত্যাচার করে। আমি বাক্কা দিন (১০/১২ দিন) হইছে আছি। এখন এরার অত্যাচার আমি সহ্য করতে পারি না দেইক্কা কইছি আমি যাইমু গা। এই কথা বলায় ওরা আরও বেশি অত্যাচার করে। আমি এজেন্সির অফিসে ফোন দিছি। অফিসের এরা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। আমি আর পারতাছি না। তোমরা যেভাবে ভাবো পারো আমারে বাঁচাও। এরা আমারে বাংলাদেশ পাঠাইতো চায় না। এরা আমারে ইতা করতাছে। আমারে ভালা কামের (কাজের) কথা কইয়া পাঠাইছে দালালে। আমারে ইতা করতাছে ওরা। আমি আর পারতাছি না সহ্য করতাম। তোমরা যেভাবে পারো আমারে নেও।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের হুসনা আক্তার (২৪) আর্থিক সচ্ছলতার জন্য গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে ১৭দিন আগে ‘আরব ওয়ার্ল্ড ডিস্ট্রিভিউশন’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব যান। সেখানে গৃহকর্তার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রথমে স্বামী শফিউল্লাকে ভিডিও বার্তা পাঠান।
হুসনার স্বামী ‘আরব ওয়ার্ল্ড ডিস্ট্রিভিউশন’ এজেন্সিতে গিয়ে এসব কথা জানালে এজেন্সির সংশ্লিষ্টরা তার কাছে ১ লক্ষ টাকা দাবি করেন। এবং হুসনা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। আর্থিক অসচ্ছল শফিউল্লা কোনো উপায় না পেয়ে স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য ওই ভিডিও তার এক ভাইয়ের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করান।
হুসনার পরিবার সূত্রে জানা যায়, বিয়ের তিন মাসের মাথায় বাবা মাকে আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য সৌদি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হুসনা। ১৭ দিন আগে হবিগঞ্জের শাহিন নামে এক দালালের সহেেযাাগিতায় ‘আরব ওয়ার্ল্ড ডিস্ট্রিভিউশন’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজে সৌদি যান হুসনা। এজেন্সি থেকে বলা হয় বাসা বাড়ির কাজ করতে হবে। এতে তাকে মাসিক ২২ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। তবে সৌদি গিয়ে কাজে যোগদানের পরই আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন ভাঙ্গে হুসনার। সৌদি গিয়েই বিপাকে পরেন তিনি। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও গৃহকর্তার নির্যাতনে শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন হুসনা।
সৌদি যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই সেখানে নির্যাতনের কথা স্বামীকে জানান। স্বামী বলেন, ফিরে আসার জন্য। তাই তিনি সৌদি আরবের এজেন্সির অফিসে ফোন করেন। কিন্তু সৌদি আরবের এজেন্সির লোকজন তাকে বাংলাদেশে পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং তাকে অকথ্য গালাগালি করে। ২ বছরের মধ্যে তাকে দেশে পাঠানো যাবে না বলে জানিয়ে দেয় সৌদি আরবের এজেন্সির দায়িত্বরতরা।
এদিকে কোনো উপায় না দেখে দালাল শাহিনকে কল করে সব জানান হুসনার স্বামী শফিউল। তিনি তার আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে বলেন শাহিনকে। কিন্তু শাহিন স্ত্রীকে ফেরত আনার বদলে তার কাছে ২ লক্ষ টাকা দাবি করেন। পরে শফিউল ঢাকায় ‘আরব ওয়ার্ল্ড ডিস্ট্রিভিউশন’ এর অফিসে সরাসরি গিয়ে কথা বলেন। শাহিন ২ লক্ষ টাকা চাইছে সেটাও বলেন। কিন্তু সেখানেও কোনো লাভ হয়নি। ওই এজেন্সির কর্তব্যরতরা বলেন, ২ বছরের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে। এর আগে আনা যাবে না। এর আগে দেশে আনতে হলে ১ লক্ষ টাকা এজেন্সিকে দিতে হবে।
হুসনার স্বামী শফিউল্লাহ বলেন, আমার স্ত্রী সৌদি যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই আমাকে কল দিয়ে নির্যাতনের কথা জানায়। আমি তাকে ফিরে আসার জন্য বলি। কিন্তু এজেন্সির লোকজন তাকে আসতে দিচ্ছে না। এজেন্সিতে কল দিয়ে নির্যাতনের কথা জানিয়ে দেশে ফেরার কথা বললে আমার স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালি দেয় এজেন্সির লোকজন। আমার স্ত্রী বলেছে, যেখানে কাজ করে সেখান থেকে এজেন্সিতে গেলে এজেন্সির লোকজন গায়ে হাত তোলে, মারাত্মক নির্যাতন করে। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।
তিনি বলেন, তিন মাস আগে আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ২ মাস সে নেত্রকোনায় আমার বাড়িতে ছিল। এরপর আমার শশুড়বাড়ি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার আনন্দপুরে যাই। সেখানে হুসনার বাবা মা তাকে বিদেশ পাঠানোর কথা বলেন। তারা বাবা মার কথার উপর ভরসা করে আমি ও আমার পরিবারের লোকজন বিদেশে যাওয়ার সম্মতি দেই। এখন মনে হচ্ছে সৌদি পাঠানো ভুল হয়েছে। শফিউল্লাহ বলেন, স্ত্রীকে দেশে ফেরানোর জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। যে যেখানে বলছে যাচ্ছি।