পণ্যের নকশা ও উপাদানে বৈচিত্র না থাকায় রপ্তানিতে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি এগোতে পারছে না কৃষি হস্ত ও কুটির শিল্প

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ শিল্পে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির চিত্র ফুটে ওঠে, যার নির্মাতা পল্লী অঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে এর সাথে সম্পৃক্তদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দলিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। নিজেদের জীবিকা এবং ব্যবহারের জন্য তারা এ সকল পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি, লতাপাতা, গাছপালা, নদ-নদী ও আকাশ কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের ডিজাইনে বা মোটিভে ফুটে উঠে। কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পকে অনেকে হস্তশিল্প, কারুশিল্প, সৌখিন শিল্পকর্ম, গ্রামীণ শিল্পও বলে থাকেন। বর্তমানে শহর এলাকায়ও কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটছে। শুধু তাই নয় আধুনিক যুগেও বিভিন্ন দেশে আজ তা রপ্তানি হচ্ছে। ফলে এ খাত থেকে অর্জিত হচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। যা আমাদের স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
হবিগঞ্জ বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ দেওয়ান মিয়া বলেন, একটি জাতির লোকজ শিল্প হচ্ছে তার প্রাণ। এ ক্ষেত্রে কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের মাধ্যমেই প্রতিফলিত হয়ে থাকে একটি দেশ ও জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বর্তমানের উন্নয়নের ধারা। মানুষের জীবন ধারায় হাতের কাজ যাকে বলা হয় হস্তশিল্প। আর হস্তশিল্পের ঐতিহাসিক ধারার মধ্য দিয়ে নিজস্ব স্বকীয়তাকে সারা বিশ্বে প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে পণ্য উৎপাদনে নীরব বিপ্লব ঘটছে বাংলাদেশে। বিদেশের বাজারেও ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে এসব পণ্য। উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা আর বিদেশীদের আগ্রহের কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ ডলারের হস্তশিল্পজাত পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। কারণ কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের সাথে জড়িতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুটির শিল্পে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হয়। মূল্য সংযোজিত হয় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার, যা জিডিপি বা দেশজ উৎপাদনে যোগ হয়। তিনি মনে করেন, কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং বা সমন্বয় করা সম্ভব হলে এই খাতে উন্নয়ন আরো বেশি হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা অনেক দিক থেকেই পিছিয়ে রয়েছি। পণ্য উৎপাদনে আমাদের খরচ বাড়ছে, কিন্তু সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। যে হারে খরচ বাড়ছে তাতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের পিছিয়ে থাকার পেছনে একটি বড় কারণ হিসেবে তিনি পণ্যের বৈচিত্র এবং নতুনত্ব¡ না থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলো সবারই নিজস্ব নকশা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল।
এছাড়া দেশে হস্তশিল্পের উদ্যোগগুলো গড়ে উঠেছে অনেকটা অগোছালোভাবে। ব্যক্তি উদ্যোগই এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে প্রদর্শন ব্যবস্থা না থাকায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে এসব পণ্যের অধিকাংশই পৌঁছায় না। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাথে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে তাঁদের চেয়ে কম মূল্যে ভালো মানের পণ্য তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার উপযোগী মান সম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশে কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের নিরব বিপ্লব ঘটবে। তাহলে এ খাত থেকে অর্জিত আয় বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারি প্রভাব রাখবে।
বিসিক শিল্পনগরী হবিগঞ্জের এজিএম (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ নাজমূল হোসেন বলেন, কুটির শিল্পের ইতিহাস খুবই প্রাচীন। মুগল যুগে কুটির শিল্প সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ইংরেজ ও ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা প্রথমদিকে বাংলার কুটির শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য তাঁত ও অন্যান্য হস্তশিল্পকে অর্থ যোগান দিত। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে এ দেশের কুটির শিল্পজাত পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ শিল্পের ব্যবসা প্রধানত হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল। দেশ বিভাগের ফলে তাদের অধিকাংশ দেশ ত্যাগ করে। ফলে কুটির শিল্পজাত ব্যবসায় বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের কুটির শিল্পসহ সমগ্র শিল্পখাত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার কুটির শিল্পকে পুনর্গঠন এবং কর্মসংস্থানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে পুনর্গঠন করে নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এই প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী নৈপূণ্যভিত্তিক প্রযুক্তির পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, সমীক্ষা প্রণয়ন, বিপনন ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে নিয়োজিত কর্মীদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। হবিগঞ্জে কুটির শিল্পের সাথে অসংখ্য পরিবার জড়িত থাকলেও হবিগঞ্জ বিসিকে প্রায় ২৫০ ক্ষুদ্র ও মাঝারী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত। আর মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত প্রায় সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাদের উৎপাদিত পণ্য থেকে অর্জিত আয়ে চলছে তাদের সংসার। পাশাপাশি তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। যা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। হবিগঞ্জে উৎপাদিত কৃষি, হস্ত ও কুটির শিল্পের মধ্যে কাঠের আসবাবপত্র, বাদ্যযন্ত্র, মাদুর, কাঠ খোদাই, কাঠের কৃষি সরঞ্জামাদি, ঘর সাজানোর দ্রব্যাদি, কাগজের ব্যাগ, খড়ি মাটি, পুতুল, দেবদেবীর মুর্তি, হাঁড়ি, ফুলদানি, চাটাই, মাছধরার ফাঁদ, হাতপাখা, মোড়া, সোফাসেট, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি, ফিল্টার উল্লেখযোগ্য।
একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় এ শিল্পের কারিগরদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তিনি আরো বলেন, পণ্যের নকশা ও উপাদানে বৈচিত্র না থাকায় কারিগররা পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথাযথ প্রস্তুতি ও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র টেকনিক্যাল ট্রেডে দেয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ। উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে আর্থিক ঋণসহ সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে বিসিক।