ইংল্যান্ড বিশ^কাপ ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দারুণ জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল আর পাকিস্তানের বিপক্ষে পরাজয় বরণ করে শেষ হলো বাংলাদেশের
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইংল্যান্ড বিশ^কাপ ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দারুণ জয় দিয়ে শুরু হয়েছিল আর পাকিস্তানের বিপক্ষে পরাজয় বরণ করে শেষ হলো বাংলাদেশের। সেমিফাইনালের আশা শেষ হয়েছিল আগেই। আশা ছিল অন্তত শেষটা রাঙানোর। কিন্তু হলো না। গতকাল লর্ডসে আসরে নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে ৯৪ রানে হার দেখে মাশরাফি বাহিনী। এতে আসরের লীগ পর্ব থেকে বিদায় নেয় দুদলই। আর খেলা শেষে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেন, আমরা হতাশ। আসরে সাকিব আল হাসান ব্যাটে-বলে যেমন তুখোড় নৈপুণ্য দেখালো তাতে দল অবশ্যই সেমিফাইনালে খেলা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারিনি।’ ভক্ত সমর্থকদের আশার বানীও শোনান টাইগার অধিনায়ক। মাশরাফি বলেন, আমরা দল হিসেবে এগিয়ে যাবো। আগামী বিশ্বকাপে আরো শক্তিধর দল হিসেবে আবিভূর্ত হবে বাংলাদেশ।
পাকিস্তানের সঙ্গে ৯৪ রানে হেরে বিশ্বকাপ মিশন শেষ করল বাংলাদেশ। পাকিস্তানের করা ৯ উইকেটে ৩১৫ রানের জবাবে ২২১ রানেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ। ব্যর্থতার মিছিলে যোগ দেননি সাকিব আল হাসান। মাথা উঁচু করেই শেষ করেছেন বিশ্বকাপ। শেষ ম্যাচেও করেছেন অর্ধশতক। দলকে জেতানোর জন্য তামিম-মুশফিক-লিটন-মাহমুদুল্লাহর সঙ্গে জুটি গড়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হল না। ৬৪ রান করে থেমেছেন সাকিব আল হাসান।
২০১৯ বিশ্বকাপটা স্মরণীয় হয়ে রইল সুপারম্যান সাকিবের। রান করলেন মোট ৬০৬। উইকেট পেয়েছেন ১১টি। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান তাঁর। ৬০৬ রান নিয়ে শীর্ষে আছেন তিনি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রোহিত শর্মার রান ৫৪৪।
বাংলাদেশ বললে সাকিব স্তুতি। এটাই ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের মূল বক্তব্য। অন্যদের কেউ কেউ কোনো কোনো দিন ভালো খেলবেন। আজও সেটাই হল। সাকিব ছাড়া অন্যরা নিভেই রইলেন। এমনকি মুশফিকও!
৩১৫ রানে শেষ হয়েছে পাকিস্তানের ইনিংস। সেমি ফাইনালে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে ৭ রানের মধ্যে অল আউট করতে হবে। ওই রূপকথা ঘটাতে পারেননি সরফরাজরা!
কিছু করে দেখানোর পালা ছিল বাংলাদেশের। লর্ডসে খেলা। আগ্রহটা তাই তামিমকে নিয়ে ছিল। বিশ্বকাপে ব্যর্থই ছিলেন তামিম। লর্ডসও ফেরাল তাঁকে খালি হাতে। মাত্র ৮ রানে শাহিন আফ্রিদির বলে বোল্ড হন তিনি। উড়ন্ত সূচনা এনে দিয়েছিলেন সৌম্য সরকার। কিন্তু ২২ বলে ২২ রান করার পর তিনিও আউট হয়ে যান। আমিরের বলে আউট হন তিনি।
ঠিক ১৮ তম ওভারে ওয়াহাব রিয়াজের বলে বোল্ড হন মুশফিক। তিনি করেন ১৯ বলে ১৬ রান। সাকিবকে নিয়ে মুশফিক জুটি গড়ার চেষ্টা করছিলেন।
লিটন এসে সাকিবের সঙ্গে জুটির গড়ার চেষ্টা করছিলেন। থিতুও হয়েছিলেন। কিন্তু জমাতে পারলেন না। ৪০ বলে ৩২ রান করে শাহিন আফ্রিদির বলে আউট হয়ে যান তিনি। মাহমুদুল্লাহ করেছেন ৪১ বলে ২৯ রান এবং মোসাদ্দেক করেছেন ২১ বলে ১৬ রান। যা দলের জন্য অপ্রতুল। বাংলাদেশের যা সর্বনাশ করার তা শাহিন আফ্রিদিই করছেন। ৯ ওভার ১ বলে ৩৫ রান দিয়ে ৬ উইকেট নিয়েছেন তিনি।
ভারত যেমন পথ হারিয়েছিল মুস্তাফিজে, ঠিক পাকিস্তানের একই অবস্থা হলো। ৫০ ওভার শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ হলো ৯ উইকেটে ৩১৫ রান। মুস্তাফিজ পেলেন পাঁচ উইকেট। বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টানা দ্বিতীয়বার ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়লেন মুস্তাফিজ।
রানটা ৩০০ এর ভেতরেই রাখা যেত। ইমাদ ওয়াসিম ২৬ বলে ৪৩ রানের একটি ঝড়ো ইনিংস খেলেন শেষ দিকে। মুস্তাফিজ ১০ ওভারে ৭৫ রান দেন। তবে ভালো বল করেন মিরাজও। ১০ ওভারে ৩০ রান দিয়ে নিয়েছেন একটি উইকেট। সাইফউদ্দিন ৯ ওভারে ৭৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ৩ উইকেট।
চার রানের জন্য বাবর আজম শতক না পেলেও ইমাম ঠিকই শতক পূরণ করে প্যাভিলিয়নে ফিরেছেন। ঠিক ১০০ বলে ১০০ করে হিট উইকেট হয়েছেন তিনি।
সান্ত¡নার জয়ের খোঁজে লর্ডস ক্রিকেটে গ্রাউন্ডে নিজেদের প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। তবে টাইগারদের হারিয়ে মুখ রক্ষা করেছে পাকিস্তান। ম্যাচে বড় কিছু পাওয়ার ছিল না, তারপরও দুই দলের সমর্থকরা হতাশ করেননি নিজ নিজ দলকে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্তরা শেষ বেলাতে এতটাই হতাশ হন যে খেলা শেষ হওয়ার আগেই মাঠ ছাড়েন দ্রুত। দিনের শুরুতেই টাইগার ভক্তদের হৃদয় ভাঙে বাজে ফিল্ডিং আর ধারহীন বোলিং দেখে। তাদের দেয়া ‘জীবন’ পেয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজার দলের উপর চড়াও হয়ে ইমামুল হক সেঞ্চুরি করেন। আর ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরিবঞ্চিত হলেও দলকে বড় সংগ্রহের লড়াইয়ে এগিয়ে রাখেন দুই দুইবার জীবন পাওয়া বাবর আজম। শেষ বেলাতে মোস্তাফিজ ৫ উইকেট তুলে না নিলে ৩১৫ রানে বাঁধা পড়তোনা তারা।
জবাব দিতে নেমে আরো একবার ভক্তদের হৃদয়ে আঘাত হানেন তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকাররা। এদিনও একাই লড়াই করেছেন টাইগারদের সুপারম্যান হয়ে উঠা সাকিব আল হাসান। ৫ম ফিফটি তুলে নিয়ে ফের হয়েছেন উঠে আসেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকার শীর্ষে। তবে তিনি আউট হতেই বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ২১৪ রানে। এবারের বিশ্বকাপে এটি বাংলাদেশের সর্বনি¤œ স্কোর। শুরুতে সমীকরণ ছিল সেমিফাইনালে যেতে হলে বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪০০ রান করেন ৩১৬ রানে জিততে হবে পাকিস্তানকে। তবে পাকিস্তানের ইনিংস শেষ সম্ভাবনা বিলীন হয় তাদের। ৩১৫ রানের পুজি নিয়ে পাকিস্তানের সামনে সমীকরণ দাঁড়ায়- টাইগারদের ৭ রানে অলআউট করতে হবে!
৩১৬ রানের লক্ষ্য! প্রেসবক্স থেকে বের হলেন লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের এক কর্মকর্তা তার চোখে মুখে ভীষণ হতাশা। বললেন, ‘কি করলো বাংলাদেশ! এমন বাজে ফিল্ডিং করলো যে ম্যাচটাই হাতছাড়া হয়েছে বলতে পারি। কারণ এখানে ৩শ’ তাড়া করে জয় সম্ভব নয়। ওদের বোলাররা দারুণ ছন্দে আছে। বিশেষ করে আমির, শাহীন।’ দায়িত্বহীন ব্যাটিংটাও কম দায়ী নয় এই হারের জন্য। তামিম ও সৌম্যের নড়বড়ে শুরু থেকে কাঁপন ধরেছিল ভক্তদের অন্তরে। বেশ কিছু দর্শক গ্যালারি ছেড়ে চলে আসেন বাইরে। কেউ পায়চারি করছেন, কেউ উদাস ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একে অপরকে সান্ত¡নাও দিচ্ছেন কেউ কেউ। হঠাৎ করেই সৌম্য বদলে দিলেন পরিস্থিতি। ২২ বলে তুলে নিলেন একই সমান রান। তবে ফের দায়িত্বহীন বাজে একশটে আমিরের বলে ক্যাচ তুলে দিলেন। অথচ শুরুতেই জীবন পেয়েছিলেন। যা কাজে লাগাতে পারলেন না তিনি। এরপর তামিমের জন্য প্রার্থনা, কিন্তু বাজে সময়টা তার যেন শেষই হলনা। চেষ্টা করছিলেন, ধুকে ধুকে করেছিলেন ২১ বলে ৮ রান। তবে খুব সতর্ক থাকার পরও বুঝতে পারেননি বাঁহাতি পেসার আফ্রিদির স্লোয়ার। ড্রাইভ করতে এগিয়ে একটু তাড়াহুড়া করে ব্যাট চালান। তাতেই ভেঙে যায় স্টাম্প। দুই ওপেনারের বিদায় ৪৯ রানে।
ততক্ষণে দলের হাল ধরেছেন সাকিব আল হাসান। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আগের দিন আঘাত পাওয়া মুশফিকুর রহীম। ডাক্তারি পরীক্ষা-নীরিক্ষায় টিস্যু ফেটে যাওয়া ধরা পড়লেও তিনি ঠিকই মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু তার ‘হাফ ফিট’ হয়ে মাঠে নামার খেসারত দলকে ঠিকই দিতে হয়েছে। আউট হয়েছেন ১৬ রান করে। ওয়াহাব রিয়াজের বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরেন বাংলাদেশের এই ব্যাটিং ভরসা। ১৮ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ৭৯/৩। সেখান থেকে লিটনকে নিয়ে লড়াই শুরু করেন সাকিব। দারুণ সঙ্গ দিচ্ছিলেন লিটন। তাদের দু’জনের ব্যাটিং থেকে হতাশ টাইগার সমর্থকরা আবারো গ্যালারিতে ফিরতে শুরু করেন। ৫৮ রানের জুটি গড়েও তোলেন তারা। কিন্তু সেই মুহূর্তে লিটন করে বসেন ভুল। রান তোলার তাড়াই যেন তাকে সেই পথে নিয়ে যায়। ফলাফল ৩২ রান ফিরে যান সাজঘরে। এরপর শুধুই সাকিব। বিশ্বকাপে ৫ম ফিফটি তুলে নিয়ে ঢুকে পড়েন রেকর্ড বুকে। এক আসরে ৬০০ রান ছাড়িয়ে যান। তবে কত চাপ নিবেন, হাল ছাড়েন ব্যক্তিগত ৬৪ রানে।
এরপর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ আর মোসাদ্দেকের ৪৮ রানের জুটিটা শুধু হারের ব্যবধানটাই কমিয়েছে। এই দু’জন ফিরে গেলে মাশরাফির ১৪ বলে ১৫ রানের ইনিংসে দলীয় ২০০’র কোঠায় পৌছে স্কোর। পাকিস্তানের বল হাতে ৯.১ ওভারের স্পেলে ৩৫ রানে ছয় উইকেট নেন ১৮ বছর বয়সী শাহীন আফ্রিদি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে পাঁচ উইকেট নেয়া সবচেয়ে কমবয়সী খেলোয়াড় তিনি।
৯ ম্যাচে ১১ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার পঞ্চম স্থানে পাকিস্তান। সমান পয়েন্ট নিয়ে নেট রান রেটে সেমিফাইনালের টিকিট পায় নিউজিল্যান্ড।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com