স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যার নির্দেশনায় হবিগঞ্জ সদর সার্কেলের ৩টি থানাধীন ৫টি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে সদর সার্কেলে যোগদান করেন মো. রবিউল ইসলাম। যোগদানের পর তিনি পুলিশ সুপারের নিদের্শনায় একাধিক হত্যা মামলার আসামী গ্রেফতার ও মামলার রহস্য উদঘাটন করেন। এর মধ্যে শায়েস্তাগঞ্জের চাঞ্চল্যকর বিউটি হত্যা, লাখাইয়ে প্রেমিকা কর্তৃক প্রেমিক উজ্জল হত্যা, মনতৈল গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ হত্যা, হবিগঞ্জ সদর উপজেলার পৈল গ্রামে প্রবাসীর স্ত্রী সাজেদা খাতুন হত্যা, হবিগঞ্জ ধুলিয়াখালে টমটম চালক তৌহিদুর রহমান হত্যা, হবিগঞ্জ নয়াপাথারিয়া গ্রামের ব্যাটারী চালিত রিকশাচালক সাজন মিয়া হত্যা রহস্য উদঘাটন করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ২০ জানুয়ারি বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন পূর্ব মোড়াকরি গ্রামের শাহ আলমের ছেলে উজ্জল (২১)। নিখোঁজ হওয়ার ছয়দিন পরে ২৬ জানুয়ারি লাখাই থানায় উজ্জলের বাবা জিডি করেন। ১ মাসের অধিক সময় নিখোঁজ উজ্জলের কোন সন্ধান না পাওয়ায় বিষয়টি তদন্ত শুরু করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম। উজ্জলের চারিত্রিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত হওয়াসহ প্রযুক্তির সহায়তায় ভিকটিম উজ্জলের মেলামেশা চলাফেরা গতি প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। তার বন্ধু-বান্ধবীদের মোবাইল নম্বর সম্পর্কে জ্ঞাত হন। মোবাইল নম্বর সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে ভিকটিমের বন্ধু বান্ধবীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ২১ এপ্রিল উজ্জলের প্রেমিকা ফারজানা ও তার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লাখাই থানায় নিয়ে আসা হয়। ৯ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু তথ্য পান। সেগুলো উজ্জলের সন্ধান পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়ায় পরের দিন সকাল থেকে আবারও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ফারজানা উজ্জলকে হত্যার কথা স্বীকার করে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। তার বর্ণনা ও দেখানো মতে মুড়িয়াউক মেদি বিল থেকে উজ্জলের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হন তিনি। এ ঘটনায় লাখাই থানায় হত্যা মামলা রুজু হয়।
২০১৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার পৈল গ্রামে প্রবাসী মোঃ সঞ্জব আলীর স্ত্রী সাজেরা খাতুন (৫০) কে তার নিজ গৃহে হত্যা করা হয়। ৯ মাস তদন্ত করে তদন্তকারী কর্মকর্তা মূল রহস্য উদঘাটনে কোন কোল-কিনারা করতে না পারায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ব্যক্তিগতভাবে মামলার রহস্য উদঘাটনে তৎপর হন। তিনি মামলার বাদী, সাক্ষী ও ঘটনাস্থল ও আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার জড়িত হিসেবে নাজিরপুর গ্রামের আব্দুর নুরের ছেলে মোঃ আব্দুর রউফ আটক করেন। পরবর্তীতে তার দেয়া তথ্য মতে একই গ্রামের ফুল মিয়ার ছেলে জাহাঙ্গীর (৩৫) ও আব্দুল মন্নাফের ছেলে ধনাই মিয়া (২২) গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের তিনি নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে আসামী জাহাঙ্গীর ও আব্দুর রউফ বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
২৭ শে মে টমটম চালক তৌহিদুর রহমান ওরফে সাবাজ মিয়া হবিগঞ্জ ধুলিয়াখাল-নছরতপুর বাইপাস রোডে টমটম ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন। এ সময় টহলে থাকা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাৎক্ষনিক আসামী বিলাশকে সন্দেহজনক আটক করেন। টহল পুলিশের মাধ্যমে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষনিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ধৃত আসামীকে সুকৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদকালে উক্ত আসামী তার সহযোগী আসামীদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করে। সাথে সাথে পুলিশ অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে বিলাশের সহযোগী আসামীদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। গ্রেফতারকৃত আসামীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদকালে টমটম ছিনতাই করার জন্য টমটম চাকলকে হত্যা করেছে মর্মে স্বীকার করে। গ্রেফতারকৃত আসামী বিজ্ঞ আদালতে হত্যার বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
৩০ মার্চ লাখাই উপজেলার মনতৈল গ্রামের দক্ষিণে তালুকদার হাওরে রাতে ইরি জমিতে সেচের পানি দিতে গিয়ে কৃষক আব্দুল হামিদ খুন হন। পরবর্তীতে হত্যাকারী ডিপ টিউবওয়েলের পাহারাদার মোঃ আছমত আলী ভিকটিমের বাড়িতে গিয়ে জানায় অজ্ঞাত দুস্কৃতিকারীরা আব্দুল হামিদকে ধরে নিয়ে গেছে। পরে আব্দুল হামিদের ছেলে ও আত্মীয় স্বজন হাওরে খোঁজাখুজি করে কৃষক আব্দুল হামিদের লাশ দেখতে পান। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দায়েরের পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং অভিযান পরিচালনা করে ঘটনার সাথে জড়িত আসামী মোঃ ছায়েদ মিয়া এবং মন্তু মিয়াকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারকৃত আসামীদেরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তারা হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেন এবং বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান কর।
২০১৮ সালের ৮ আগস্ট হবিগঞ্জ আলম বাজারস্থ তাজ উদ্দিন ও মহিউদ্দিন এর মালিকানা টমটম চার্জের গ্যারেজে টাকা ভাঙ্গানোকে কেন্দ্র করে আসামী তারেক মিয়ার সাথে ভিকটিম সাজন মিয়ার কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে আসামীরা সাজন মিয়াকে এলোপাতাড়ি লাঠি দিয়ে আঘাত করে তার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করে। পরবর্তীতে ঘাতকরা সাজন মিয়া বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়েছে মর্মে প্রচার করে চিকিৎসার জন্য আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণার করার পর পরই ঘাতকরা দ্রুত হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনা থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পিএম রিপোর্ট পাওয়ার পর দেখা যায় সাজন মিয়া আঘাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে মর্মে ডাক্তার মতামত প্রদান করেন। এ ঘটনায় পরবর্তীতে ওই বছরের ২৯ নভেম্বর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দায়েরের পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ রবিউল ইসলাম মামলার রহস্য উদঘাটনের ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ঘটনার সাথে জড়িত আসামী মিজানুর রহমান প্রকাশ মিজানকে গত ২১ মে গ্রেফতার করা হয়। এরপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থানায় উপস্থিত হয়ে মিজানকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মিজান হত্যাকান্ডের বর্ণনা দেয় তার কাছে। পরে বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন মিজান। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাজু মিয়া হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন হয়।