মাহফুজুর রহমান নবিন নারীদেরকে টার্গেট করে অশ্লীল ছবিতে তাদের মাথা জুড়ে দিয়ে চরিত্র হনন এবং তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করতো। এভাবে তিনি স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করতেন। শুধু তাই নয় তিনি পরিকল্পিতভাবে ভেঙ্গে দিয়েছেন অনেকের সংসার ॥ তার অপকর্মের শিকার হয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা মিডিয়া কর্মী সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে ভার্সিটি পড়–য়া শিক্ষার্থী চাকরিজীবী ও গৃহিনী

এসএম সুরুজ আলী ॥ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, মিডিয়া কর্মী, দেশজুড়ে পরিচিত সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে ভার্সিটি পড়–য়া শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী এবং গৃহিনী কারও ফেসবুক আইডি হ্যাক করার বাকি নেই মাহফুজুর রহমান নবিনের। নবিন গড়ে তুলেছেন ফেসবুক আইডি হ্যাক করার বিশাল সা¤্রাজ্য। অনেককেই ব্ল্যাকমেইল করে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। অশ্লীল ছবি বা ভিডিও তৈরি করে পাঠিয়ে ভেঙ্গেছেন কারও সংসার। কখনও আবার র‌্যাব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে মানুষকে হুমকি ধামকিও দিয়েছেন। হাতিয়ে নিয়েছেন টাকা-পয়সা। তার মূল টার্গেটে রয়েছেন ফেসবুক ব্যবহারকারী নারীরা। ভয়ঙ্কর এ সাইবার অপরাধী চক্রের সব তথ্য ইতোমধ্যে সংগ্রহ করে নিয়েছে র‌্যাব। র‌্যাবের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তার ভয়ঙ্কর অপরাধের সব চিত্র। এসব অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার তিতারকোণা মামদনগর গ্রামের বাসিন্দা মৃত ইজাজুর রহমানের ছেলে মাহফুজুর রহমান নবিনকে (২৮)। তার বিরুদ্ধে র‌্যাব-৯ সিলেটের এসআই পঙ্কজ দাশ বাদি হয়ে সাইবার অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে র‌্যাব-৯ সিলেটের অপারেশন অফিসার আনোয়ার হোসেন শামীম জানান, তার একটি বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। কয়েক মাসের নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায় এ ধূর্ত অপরাধীকে আটক করা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য সাইবার অপরাধীদেরকেও আইনের আওতায় আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি ক্রমবর্ধমান এ অপরাধ প্রতিরোধে অনলাইনভিত্তিক অ্যাপসমূহ ব্যবহারে সবাইকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান।
র‌্যাব সূত্র জানায়, টার্গেট করার ক্ষেত্রে নারীদেরকেই তিনি সাধারণত প্রাধান্য দিতেন। ফেসবুক আইডি হ্যাক করার পর প্রথমে তিনি আইডির মালিককে মানসিক চাপ দেয়ার উদ্দেশ্যে আইডিতে থাকা একান্ত ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও, ডকুমেন্টস বিভিন্ন জনকে পাঠিয়ে দিতে থাকেন। তারপর ধারাবাহিকভাবে হ্যাককৃত আইডি ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন, সম্ভাব্য সকল উপায়ে আইডির মালিকের সম্মান বিনষ্ট করা এবং সবশেষে এ আইডিগুলো ব্যবহার করে বিভিন্নমুখী, বিচিত্র প্রতারণার জাল বিস্তার করাই ছিল তার পেশা।
র‌্যাবের দাবি- আটক নবিন অসংখ্য নারীকে টার্গেট করে অশ্লীল ছবি ও ভিডিওতে তাদের মাথা জুড়ে দিয়ে চরিত্র হনন এবং তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে। এভাবে তিনি স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করতেন। পরিকল্পিতভাবে ভেঙ্গে দিতেন দীর্ঘদিনের সাজানো সংসার। এছাড়াও টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ফরমায়েশ নিয়েও তিনি এ কাজটি করতেন। তার ছবি বিকৃতির তালিকা থেকে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা বিদেশি সরকার প্রধানরাও বাদ পড়েননি। এছাড়াও অনলাইনে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে বিষোদগার ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য তার কাছে নৈমিত্তিক ব্যাপার বলে জানা যায়। র‌্যাবের হাতে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার উদ্ভাবনী সব প্রতারণার কৌশল এবং ভয়ঙ্কর অপরাধ প্রবণতার কথা জেনে উপস্থিত র‌্যাব কর্মকর্তারাও হতবাক হয়ে পড়েন। এ পর্যন্ত র‌্যাবের কর্মকর্তা, টেলিভিশন উপস্থাপিকাসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ফেসবুক আইডি হ্যাক এবং একই নাম ও ছবি ব্যবহার করে আইডি বানিয়ে তাদের ব্যক্তি ইমেজ ব্যবহার করে অভিনব সব উপায়ে সাইবার অপরাধে লিপ্ত হন নবিন। এছাড়াও চিত্রনায়িকা মৌসুমী, সংগীত শিল্পী কৌশিক হাসান তাপসসহ আরো অনেকেরই ফেসবুক আইডি হ্যাক করার জন্য তিনি টার্গেট করেছিলেন মর্মেও প্রমাণ পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তারা। পরে বুধবার দিবাগত রাত ১টার দিকে তাকে বাহুবল থানায় হস্তান্তর করা হয়। তার বিরুদ্ধে অন্যের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ব্যবহার, হ্যাক চেষ্টা, আইডি ডিজেবল করে দেয়ার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত করা, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ উপার্জন, অনলাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্য মন্ত্রী ও বিদেশি সরকার প্রধান সম্পর্কে নোংরা, কুরুচিপূর্ণ ও মিথ্যা মন্তব্য করা, অশ্লীল ছবি ও ভিডিওতে বিভিন্ন জনের মাথা জুড়ে দিয়ে ছবি ও ভিডিও বানিয়ে সেটা ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইল ও অনলাইনে পর্নোগ্রাফি কন্টেন্ট বহন, স্থানান্তর ও ছড়িয়ে দেয়াসহ সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত অন্যান্য অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন শামীম।
তার বিরুদ্ধে র‌্যাব-৯ সিলেটের এসআই পঙ্কজ বাদি হয়ে সাইবার অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারের সাথে তার অপরাধের ১৩৯ পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট জমা দেয়া হয়েছে। আর সাইবার অপরাধীদের তথ্যের ১২৬৫ পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট সংগ্রহ করেছে র‌্যাব। গত বুধবার দিবাগত রাত ১টায় তাকে বাহুবল থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। এর আগে বিকেলে তাকে আটক করে র‌্যাব-৯ সিলেট ক্যাম্পে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এসব তথ্য নিশ্চিত করে র‌্যাব-৯ সিলেটের অপারেশন অফিসার শামীম আনোয়ার জানান, আটক মাহফুজের বিশাল একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে।