এসএম সুরুজ আলী ॥ দখল দূষণের প্রায় ৩ যুগ পর প্রাণ ফিরে পাচ্ছে হবিগঞ্জের পুরাতন খোয়াই নদী। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। গতকাল সোমবার সকাল ১১টায় শহরের মাহমুদাবাদ এলাকা থেকে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। প্রথম দিনে ডায়াবেটিক হাসপাতালের পেছন থেকে প্রতিবন্ধি স্কুল পর্যন্ত অভিযান চালানো হয়। অভিযানের ১ম দিনেই এক্সকেভেটর মেশিন দিয়ে অর্ধশতাধিক বাসা-বাড়ি ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদ কাজে ব্যবহৃত মেশিনের খরচ বহন করবে হবিগঞ্জ পৌরসভা। গতকাল উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনাকালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ শামছুজ্জামান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন রুবেল, সহকারি কমিশনার ভূমি মাসুদ রানা ও সহকারি কমিশনার ইয়াছিন আরাফাত রানা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উচ্ছেদ অভিযান শুরুর সময় স্থানীয় লোকজন ও গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। উচ্ছেদের খবর পেয়ে ৩দিন আগ থেকে অনেকেই নিজ উদ্যোগে নিজেদের স্থাপনা ভেঙ্গে মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন। আবার অনেকে সরকারি উদ্যোগে ভাঙ্গলে জরিমানা গুনতে হবে এ আশঙ্কায় নিজ উদ্যোগেই নিজেদের স্থাপনা ভেঙ্গে নিচ্ছেন।
হবিগঞ্জ শহরকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে ১৯৭৬ সাল থেকে দুই দফায় মাছুলিয়া থেকে কামড়াপুর পর্যন্ত খোয়াই নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। ১৯৭৬-৭৭ সালে মাছুলিয়া থেকে রামপুর পর্যন্ত ৩ কি.মি এবং ১৯৭৮-৭৯ সালে রামপুর থেকে কামড়াপুর গরুর বাজার পর্যন্ত আরও ২ কিলোমিটার গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে নদীর পুরোনো অংশটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতা, সরকারি চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, আইনজীবীসহ নানা পেশার মানুষ নদীর পুরোনো অংশটি দখলে নিতে থাকেন। এক সময় নদী তার অস্থিত্ব¡ হারিয়ে কোথাও খাল, আবার কোথাও ড্রেনে পরিণত হয়। শহরের পানি নিষ্কাশনের একটি বিশাল জলাধার ছিল পুরনো খোয়াই নদী। কিন্তু বর্তমানে নদীটি দখল হয়ে যাওয়ায় শহরে মারাত্মকভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। নদীটি উদ্ধারের দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে। এতে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মোহিত, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানসহ অনেকেই। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন নদীটি উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়। তারা শুধু মাপঝোকেই থেমে থাকেননি।
অব্যাহত দখলের ফলে ২শ’ ফুট প্রশস্ত নদীটি বর্তমানে নালায় পরিণত হয়েছে। দখলদারদের তালিকায় রয়েছেন রাজনীতিবিদসহ সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা। সরকারিভাবেও নদী ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে জেলা পরিষদ ভবন, মেজর জেনারেল এমএ রব স্মৃতি পাঠাগার ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ।
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন রুবেল জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে আমরা খোয়াই নদী উদ্ধারে নেমেছি। বিপুলসংখ্যক শক্তিশালী ভবন এখানে থাকায় উচ্ছেদ অভিযান শেষ হতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।
জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ বলেন, গত কয়েক দিনে সরেজমিনে সরকারি জায়গা পরিমাপ করে ৬শ’ দখলদারের নাম তালিকাভুক্ত করেছি। এর মধ্যে অনেকেরই অফিস, বিল্ডিং, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা ও বাগানবাড়ি রয়েছে। মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্থাপনা উচ্ছেদের ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা হবে। অনেক স্থাপনা উচ্ছেদের ক্ষেত্রে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলে কাগজপত্র দেখে সঠিক হলে বিবেচনা করা হবে। আর ডায়াবেটিক হাসপাতাল ও জেলা পরিষদ সরকারিভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া। সেটা আইনি প্রক্রিয়ায় দেখা হবে।
তিনি বলেন, নদী ও খালের জায়গা সরকারিভাবে কোন বন্দোবস্ত দেওয়া হয় না। যদি কোন ব্যক্তি লিজ নিয়ে থাকেন তাহলে সেটা অবৈধ। শ্রেণি পরিবর্তন বৈধ নয়। যেগুলো শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে সেগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হবে খোয়াই রিভার সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকল্প বাস্তবায়নের স্ক্যাচম্যাপ তৈরি করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সদর হাসপাতাল থেকে নাতিরাবাদ পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার পুরাতন খোয়াই নদীকে সংস্কার করে নান্দনিক করা হবে। অনেকটা ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্পের আদলে এটি করা হবে। নদীর দু’পাড় উচু করে বাঁধ নির্মাণ, দুই তীরে রাস্তা, ৫টি ব্রিজ নির্মাণ ও গাছ লাগানো হবে। পরবর্তীতে হবিগঞ্জ পৌরসভা সেখানে পার্ক ও শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করবে। এ প্রকল্পের আওতায় পুরাতন খোয়াই নদীর দু’ধারে প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পাম্প স্থাপন, পর্যটকদের জন্য বোটিং ব্যবস্থা, এলইডি সড়ক বাতি স্থাপন ও শিশুদের জন্য কিডস কর্ণার নির্মাণ করা হবে।
মসজিদ মন্দির মাদ্রাসা ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্থাপনা উচ্ছেদের ক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা হবে ॥ জেলা প্রশাসক
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com