ডাক্তারি পাশ করে আকবর ছাতকের হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার। বিকেলে ইমার্জেন্সী ডিউটি করছে। হঠাৎ রক্তাক্ত অবস্থায় ভর্তিযোগ্য এক রোগীকে দেখার জন্য ডাক পড়ল। খালি গা আর ময়লা লুঙ্গি পরিহিত ভবঘুরে এক লোক, সারা শরীর রক্তে রক্তাক্ত। ক্ষতস্থান সমূহ পরিষ্কার করে সেলাই পর্ব শেষ করার পর ডাক্তার আকবর চিনতে পারল এই রোগী মেডিক্যাল থেকে পালিয়ে যাওয়া তারই এক সময়ের ক্লাসমেট সেই মনির। এখন মতিভ্রম হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। দুষ্ট ছেলেরা দল বেঁধে পিছু লেগে ইটপাটকেল ছুড়ে এ দুরবস্থা করেছে

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

মেডিক্যালের প্রথম/দ্বিতীয় বর্ষে আমাদের সময়ে দাত ভাঙ্গা গ্রীক ও ল্যাটিন শব্দ সম্বলিত এনাটমি এবং ফিজিওলজি ছিল প্রধান পাঠ্য বিষয়। এমব্রায়োলজি বা ভ্রুণতত্ব ছিল এনাটমির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে বায়োকেমিস্ট্রি ছিল ফিজিওলজির আওতায়। শেষের দুটো বিষয়ও যথেষ্ট কঠিন ছিল (প্রায় সর্বজন সীকৃত)।
ভর্তির পর পরই এনাটমির ব্যাচ টিচার জাহাঙ্গীর স্যার স্টীম রোলার চালিয়ে দিলেন। সারভাইকেল ভারটিব্রা তথা ঘাড়ের হাড় সমূহ পড়াতে আরম্ভ করলেন। মাংশপেশী সমূহের নাম (অদ্ভুত গ্রীক ও ল্যাটিন শব্দ), এর আরম্ভ (অরিজিন), শেষ (ইনসাশন), নার্ভ সাপ্লাই, একশন এবং তৎসঙ্গে এপ্লাইড্ এনাটমি। বাপরে বাপ! আমি জানি আমার যে কোন সহপাঠী এ যাঁতাকলের নিপীড়ন এখন পর্যন্ত কেউই ভুলতে পারেনি।
দিনকয়েক ক্লাস করার পর আমাদের ব্যাচের আহসান হাবীব তাবলীগে যাওয়া শুরু করে দিল। একদিকে জাহাঙ্গীর স্যার প্রেসার বাড়াতে লাগলেন আর হাবিব সাহেবের তবলীগি চিল্লার ঘনত্ব বাড়তে লাগলো। অবশেষে চল্লিশ দিনের লম্বা চিল্লার সাথে হাবিব সাহেবেরও মেডিক্যাল জীবনের সমাপ্তি ঘটলো। এটা উনিশ’শ ছিয়াত্তরের শেষের দিকের কথা। আমি ক্লাস প্রিফেক্ট হিসেবে মাঝে মাঝে সাহস যোগাতাম। কোনই লাভ হয়নি এবং আজ পর্যন্ত হাবিবের সাথে আর কোনদিন দেখাও হয়নি। জানি না হাবিব কোথায় কেমন আছে অথবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। এমনও হতে পারে পাবনার হেমায়েতপুরেই তার বসবাস। ছাত্র জীবনে ব্যস্ততার কারণে অনুসন্ধান করতে পারিনি। আজ তার কথা এ অবেলায় কেন জানি মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
দ্বিতীয় আর একটি ঘটনা এখনো পীড়া দিচ্ছে। আমাদেরই সাথের সহজ সরল ছেলে মনির। পড়াশোনার চাপে সব সময় খুব বিমর্ষ থাকত। সহপাঠী আকবরের লিখা থেকে ওর সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারলাম। এনাটমির জাহাঙ্গীর স্যারের মত সেও ফিজিওলজির ব্যাচ টিচারের টার্গেটে পরিণত হয়েছিল। কিডনির কার্য প্রণালী ভালভাবে বুঝতে গেলে তার কাউন্টার কারেন্ট মেকানিজম (প্র¯্রাবকে ঘন করার জন্য কিডনির বিশেষ ভূমিকা) জানতে হবে। এদিকে ব্যাচ টিচার জেদ ধরেছেন তার নিকট থেকে পড়া আদায় করেই ছাড়বেন। মনির বেচারা শত চেষ্টা করেও প্র¯্রাবের এ জটিল ঘুরপাকের তত্ত্ব আয়ত্তে আনতে পারেনি। আকবর যখন একদিন তাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করল তারপর থেকে সে উধাও। আর কোনদিন মেডিক্যাল চত্ত্বরে পা রাখেনি।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। ডাক্তারি পাশ করে আকবর ছাতকের হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার। বিকেলে ইমার্জেন্সী ডিউটি করছে। হঠাৎ রক্তাক্ত অবস্থায় ভর্তিযোগ্য এক রোগীকে দেখার জন্য ডাক পড়ল। খালি গা আর ময়লা লুঙ্গি পরিহিত ভবঘুরে এক লোক, সারা শরীর রক্তে রক্তাক্ত। ক্ষতস্থান সমূহ পরিষ্কার করে সেলাই পর্ব শেষ করার পর ডাক্তার আকবর চিনতে পারল এই রোগী মেডিক্যাল থেকে পালিয়ে যাওয়া তারই এক সময়ের ক্লাসমেট সেই মনির। এখন মতিভ্রম হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। দুষ্ট ছেলেরা দল বেঁধে পিছু লেগে ইটপাটকেল ছুড়ে এ দুরবস্থা করেছে। শুনেছি চিকিৎসা শেষ করে রুমে ফিরে আকবর অনেক্ষণ কেঁদেছিল। জানি না মনিরও অদ্যাবধি বেঁচে আছে কি না। নাকি কোন মেডিক্যালেই প্রায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, ডাক্তার হিসেবে নয় বরং পাগলা গারদের একটা ওয়ার্ডে বন্দি একজন জাত পাগল হিসেবে।