শিক্ষাবিদ আব্দুল হান্নান চৌধুরী স্মৃতি বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা

শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকায় তাদের চোখ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে অল্প বয়সেই চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে ॥ ছেলেরা স্মার্টনেস হওয়ার জন্য সিগারেট খায়। সিগারেট থেকে মাদক গ্রহণ করে। মাদকের টাকার জন্য তারা প্রথমে বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে। এরপর মায়ের স্বর্ণালঙ্কার চুরি করে। এক সময় সে ছিনতাই ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে
এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম-পিপিএম সেবা) বলেছেন- নারীরা এখন সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে অনেক নারী চাকুরী করছেন। শুধু পুলিশেই নয়, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে উচ্চ পর্যায়ে চাকুরী করছেন। তাই নারীদের বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, দাঙ্গা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। গতকাল রবিবার হবিগঞ্জ বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে হবিগঞ্জ হাই স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শিক্ষাবিদ মরহুম আব্দুল হান্নান চৌধুরী স্মৃতি বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রত্যেকের ছেলেমেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়েদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুললে পরিবারে সুখ-শান্তি আসবে। শিক্ষার্থীদের উচ্চ পর্যায়ে যেতে হলে নিয়মিত স্কুলে যেতে হবে। স্কুল থেকে বাসা-বাড়িতে মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে। মা-বাবার কথা শুনতে হবে। পাশাপাশি গুরুজনদের সম্মান করতে হবে। অবসর সময়ে খেলাধুলা করতে হবে। খেলাধুলা করলে মন ভালো থাকে এবং ভাল মানুষও হওয়া যায়। কিন্তু খেলাধুলা না করে আজকাল অনেক শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনে গেমস খেলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে মোবাইল দেখার কারণে শিক্ষার্থীদের চোখে সমস্যা হচ্ছে। অকারণে শিক্ষার্থীদের চোখ নষ্ট হচ্ছে। এতে অল্প বয়সেই তাদের চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। মোবাইলের অপব্যবহারে সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের অপ্রয়োজনে মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে হবে। স্মার্টফোন শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়ংকর। শিক্ষার্থীরা যাতে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য অভিভাবকদের সচেতন থাকবে হবে। তিনি বলেন, ছেলেরা স্মার্টনেস হওয়ার জন্য সিগারেট খায়। তারা সিগারেট থেকে মাদক গ্রহণ করে। সিগারেটকে ঘৃণা করতে হবে। সিগারেট নিজের ক্ষতি, পরিবারের ক্ষতি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করে। যারা মাদক গ্রহণ করে তাদেরকে সমাজ খারাপ চোখে দেখে। মাদকের টাকার জন্য তারা প্রথমে বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে। এরপর মায়ের জমাকৃত টাকা চুরি করে, মায়ের স্বর্ণালঙ্কার চুরি করে। এক সময় মা-বাবার কাছ থেকে চুরির আর কোন কিছু না পেয়ে সে ছিনতাইসহ ডাকাতির সাথে জড়িত হয়ে যায়। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
পুলিশ সুপার বলেন, শিশু মেয়ে জানে না কিভাবে সংসার চালাতে হয়। এ অবস্থায় তাদের বিয়ে দেয়া হয়। এতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। জীবন নষ্ট হওয়ায় অনেক মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তাই বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য শিক্ষার্থীদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কোন মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিতে চাইলে পরিবারের লোকজনদেরকে বুঝাতে হবে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা যাতে বাল্যবিবাহ দিতে না পারেন, সে জন্য সকলকে সচেতন করে তুলতে হবে। বাল্যবিবাহ হলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিএ পাস ছাত্রীর বিয়ে হওয়ার পর যদি তার স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় তখন বিএ পাস মেয়েটি বলতে পারবে, আমার কাছে বিএ পাসের সাটির্ফিকেট রয়েছে। আমি কোথাও চাকুরী করবো। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি করতে পারবেন মেয়েটি। পুলিশ সুপার বলেন, ইভটিজিং প্রতিরোধেও ছাত্রছাত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি আরো বলেন, হবিগঞ্জ একটি ঐতিহ্যবাহী ও সুন্দর জেলা। কিন্তু এ জেলার একটি কংলক আছে। সেটি হলো দাঙ্গা। দাঙ্গার কারণে জেলার সুনাম বিনষ্ট হচ্ছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এ জেলার অধিবাসীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে যাচ্ছেন। সংঘর্ষ অনেক পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই সংঘর্ষ প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা রাখতে হবে। বাবা, ভাইসহ পরিবারের লোকজন সংঘর্ষে জড়িত হতে চাইলে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের বুঝিয়ে সংঘর্ষ থেকে বিরত রাখতে হবে। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ ধর্মের অপব্যাখ্যা। কাউকে বোমা মেরে হত্যা করে জান্নাতে যাওয়া যাবে না। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকারী অনেক শিক্ষার্থীদের ইসলামের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ থেকে শিক্ষার্থীদের সচেতন থাকতে হবে। সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন- ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। সবাই সমান। তবে যারা দুর্বল তারাই সংখ্যালঘু।
হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি হারুনুর রশিদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী পারমিতা চৌধুরীর পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুধাংশু কুমার কর্মকার, হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মাসুক আলী, বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক আব্দুল কবির, গার্লস গাইড লিডার সহকারী শিক্ষিকা পূর্ণিমা দাশ তালুকদার, হবিগঞ্জ টিভি জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এসএম সুরুজ আলী প্রমূখ। অনুষ্ঠানে মরহুম আব্দুল হান্নান চৌধুরীর জীবনী পাঠ করেন বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ইসমত জাহান। শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন বিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া আখনজী, গীতা পাঠ করেন মৌমিতা রায়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে দুই হাজার টাকা করে বৃত্তি প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে শেষে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলার জন্য পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। পরে অতিথিবৃন্দ স্কুলে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্ণার পরিদর্শন করেন।
প্রসঙ্গত, মরহুম আব্দুল হান্নান চৌধুরীর ছেলে সুইডেন প্রবাসী কমিউনিটি লিডার আব্দুল বাছিত চৌধুরীর আর্থিক সহায়তায় প্রতিবছর এই বৃত্তি প্রদান করা হয়ে থাকে।
মরহুম আব্দুল হান্নান চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ঃ আব্দুল হান্নান চৌধুরী ১৯২১ সালে হবিগঞ্জের দরিয়াপুর গ্রামে একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ডাঃ আব্দুল মান্নান চৌধুরী (আসামের ডিব্রুগড় থেকে ডাক্তারী পাশ করেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মাতার নাম সৈয়দা খায়রুন্নেছা, মাতুলালয় ফকিরাবাদ। সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালারের ভ্রাতা সৈয়দ শাহ ইয়াকুবের উত্তরাধিকারী।
উল্লেখ্য, তার পিতামহ আব্দুল কাদির চৌধুরী (১৮৫৩-১৯৪১) আসাম পুলিশ সার্ভিসে কর্মরত অবস্থায় ১৯১১ সালে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ মোহাম্মদ আমিন চৌধুরী লস্করপুর দেওয়ানী আদালতের মুন্সেফ বা বিচারকের পদ লাভ করেন।
আব্দুল হান্নান চৌধুরী প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে। নবকুমার ইনস্টিটিউট ছিল ঢাকার স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আব্দুল হান্নান চৌধুরী ১৯৩৯ সনে করিমগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪১ সালে রাজশাহী গভর্ণমেন্ট কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এম এ পড়াশোনা করেন ১৯৪৪ সালে। শিক্ষকতা করার সময়ে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি (১ম শ্রেণীতে ৪র্থ) ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি তার চাচা প্রিন্সিপাল আব্দুর রব চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে থেকে পড়াশোনা করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আব্দুল হান্নান চৌধুরী বৃটিশ বিমান বাহিনীতে এরোড্রাম অফিসার হিসেবে করিমগঞ্জের পাথারকান্দি এয়ারপোর্টে কাজ করেন। তিনি সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে সুরমা ও বরাক ভ্যালীর ভাঙ্গা, বদরপুর প্রভৃতি স্থানে চাকুরী করেছেন। ১৯৪৬ সালে কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি গভর্ণমেন্ট হাই স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সনে তিনি আসাম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু দেশবিভাগ এবং রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সিলেট জিলা বিভক্ত হয়ে বৃহদাংশ পাকিস্তানে এবং করিমগঞ্জসহ একাংশ আসামে অন্তর্ভূক্তির ফলে অন্য অনেকের মতো তারও ইএসি পদে চাকুরী লাভ সম্ভব হয়নি। দেশ বিভাগের শর্তানুযায়ী তিনি পাকিস্তানে অপশন দিয়ে মৌলভীবাজার গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে যোগ দেন। তারপর হবিগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে বদলি হন।
১৯৬০ সনে আব্দুল হান্নান চৌধুরী শিক্ষা বিভাগের অধীনে সহকারি স্কুল পরিদর্শকের চাকুরিতে যোগদান করেন। তিনি জামালগঞ্জ, সিলেট, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে কাজের মূল্যায়ন ও দক্ষতাবলে তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার জেলা স্কুল পরিদর্শক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর এলাকাবাসীর অনুরোধে তিনি হবিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমানে হবিগঞ্জ হাইস্কুল এন্ড কলেজ) অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি অত্যন্ত সততা ও সুনামের সাথে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করেন। প্রায় বছর তিনেক দায়িত্ব পালন করার পর পুরোপুরি অবসরে যান।
২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রায় ৮৭ বছর বয়সে এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুকালে ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে যান।
স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি হবিগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। বৃহত্তর সিলেটের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার নেতৃত্বের ছোয়া রয়েছে। এককথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন প্রকৃত শিক্ষানুরাগী, কর্মঠ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত সাদাসিদে চলাফেরা করতেন। সমাজসেবায় তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।