মনে হল নূপুরপড়া টুনি ধীরপায়ে আমার ঘরে ঢুকলো। টুন টুন শব্দ হচ্ছে। ঘুমিয়ে আছি মনে করে পায়ে একটা চিমটি কাটলো। একটা ধমক দিলাম কিন্তু পালায়নি। গম্ভীর ভাব, যেন রোদেলা আকাশে কালো মেঘের ছায়া। বললাম বস। মাথার কাছে বসেই ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। টুনির দু-একটা চুল আমার গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। দাদাভাই... ‘সম্বন্ধটা ভেঙে দাওনা। ছেলেটা দেখতে সুন্দর না। আবার সিগারেটও খায়’। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। টুনির দু’এক ফোটা চোখের জল আমার উপর টপ টপ করে পড়তে লাগলো

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

সবেমাত্র এনাটমি কার্ড পরীক্ষা শেষ হল। গ্রীষ্মের গরম তুঙ্গে। কলেজ দশ দিনের ছুটি। নয়/দশ বছর বয়স থেকে বাড়ির বাইরে, তারপরও হোমসিকনেস পুরোপুরি কাটেনি। প্রায় ছমাস পর বাড়ি চলে আসসলাম। একান্নবর্তি পরিবারে দাদি তখনও সুস্থভাবেই বেঁচে আছেন। আমার প্রজন্মে আমিই প্রথম। সুতরাং ছোটবেলা থেকেই সবার আদুরে।
আমার গ্রামে হিন্দু মুসলিম ফিফটি ফিফটি। সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র নেই। গ্রামে কোন হাই স্কুল নেই, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন কেটেছে বাড়ির বাহিরে, ফলে সমসাময়িক বন্ধুবান্ধব কম। বাড়িতেই অলস সময় কাটছিল।
এক উঠোন পরেই আমার দূর সম্পর্কের এক ফুফাত বোন তার মামার বাড়িতে থেকে প্রাইমারি শেষ করে এখানেই থাকে। বয়স তের/চৌদ্দ হবে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, কিছুটা নাদুসনুদুস, মিষ্টি চেহারায় এক গালে টোল পড়ে। আমাকে অন্য পিচ্ছিদের মত সে দাদাভাই বলেই ডাকে।
স্বভাবে খুবই চঞ্চল, ছোটবেলা থেকেই সারাটা পাড়া মাতিয়ে রেখেছে। গাছে উঠে আম পাড়া, ডাব পেড়ে জল খাওয়ানো, মেহমান আসলে টেঙ্গিয়ে মোরগ ধরতে হবে ডাক পড়ে টুনির। পায়ে নূপুর পড়ে… ছোটরা ডাকে টুন টুন…।
আমি বাড়ি আসলে আমাদের ঘরে টুনির আনাগোনা বেড়ে যায়। আমার মাকে সব কাজে যোগান দিতে পারে। শাঁক তুলতে হবে- টুনি, বড়ার জন্য কুমড়োপাতা লাগবে… টুনি । মা ও বেশ আদর করেন।
ইদানিং হঠাৎ করে টুনি একটু বড় হয়ে গেল। নজরে পড়ে। একটু লাজুকও বটে। তারপরও বড়শিতে মাছ ধরছি পেছনে ভাজা সীম বীজ নিয়ে দাঁড়িয়ে… টুনি, মাছের আধাঁর প্রয়োজন… টুনি। দুপুরে খেয়েদেয়ে শুতে যাব ইত্যবসরে বিছানা গোছানো পরিপাটি… টুনি। আমার দাদি মাঝে মাঝে একটু ক্ষেপে যান – ধিঙ্গি মেয়ে! লাজ শরম নেই? কিন্তু বাড়ির সবার মতো তিনিও স্নেহ করেন যারপরনাই। পাড়ার কারো অসুখ বিসুখ হলে ডাক পড়ে প্রথমে টুনিরই। এক কথায় বছর কয়েক ধরে পুরোটা পাড়া মাতিয়ে রেখেছে।
আমার দূর সম্পর্কের ফুফু মানে টুনির মা বেড়াতে আসলেন উনার বাবার বাড়িতে। এমনিতেও আমি বাড়ি আসার খবর পেলে দেখতে আসেন।
একদিন দুপুরে শুয়ে আছি, ফুফু কাছে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে লাগলেন… একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে – বাবার একমাত্র ছেলে, অবস্থা ভালো, যৌতুক লাগবে না, টুনিকে দেখতে চায়… তাই নিতে আসলাম। দিনক্ষণ ঠিক হলে তোমাকে থাকতে হবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম…
এত কম বয়সে বিয়ে!
কিছু না বলে ফুফু উঠে গেলেন। শুধু ভাবছিলাম টুনি চলে গেলে এ শূন্যতাটুকু পূরণ হবে কেমন করে।
কিভাবে যেন আট/নটা দিন চলে গেল। বাড়ি থেকে চলে আসার সময় ছোট বড় সবাই, মা, দাদি, চাচীরা সকলে মিলে আমাকে বিদায় দিলেন।
কিন্তু টুনিকে দেখলাম না …।
প্রায় চার ঘন্টা পায়ে হেঁটে আরও চার ঘন্টা বাসে চড়ে সন্ধ্যায় হোস্টেলে পৌঁছলাম। সবাই তখনো পৌছায়নি। আমার রুমে আমিই একা। দুদিন পর হেডনেক কার্ডের আইটেম পরীক্ষা। শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছিল। ডাইনিং হল এখানো খুলেনি, তাই বাইরেই খেতে হবে।
জ্বর একটু বেড়ে গেল মনে হয়। বেশি দূরে না গিয়ে আবুলের দোকান থেকে একটা মডার্ণ ব্রেড ও এক হালি কলা নিয়ে আসলাম। বাড়িতে এক-আঁধটু জ্বর হলে দাদি ভাত খেতে দিতেন না। আমার চাচা ভাটি থেকে (ব্যবসায়িক সূত্রে) পাউরুটি আনতেন, দুধের সংগে চিনি/মিশ্রী মিশিয়ে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ার স্বাদ এখনোও মনে আছে।
মাথার খুলিটা হাতে নিয়ে এনাটমি পড়তে বসলাম। ক্লান্ত শরীর অতপর বইতো নিজেই একটা সিডাক্সিন (ঘুমের বড়ি)। হেলান অবস্থায় কেমন করে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।
মনে হল নূপুরপড়া টুনি ধীরপায়ে আমার ঘরে ঢুকলো। টুন টুন শব্দ হচ্ছে। ঘুমিয়ে আছি মনে করে পায়ে একটা চিমটি কাটলো। একটা ধমক দিলাম কিন্তু পালায়নি। গম্ভীর ভাব, যেন রোদেলা আকাশে কালো মেঘের ছায়া। বললাম বস। মাথার কাছে বসেই ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। টুনির দু-একটা চুল আমার গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। দাদাভাই… “সম্বন্ধটা ভেঙে দাওনা। ছেলেটা দেখতে সুন্দর না। আবার সিগারেটও খায়”। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। টুনির দু’এক ফোটা চোখের জল আমার উপর টপ টপ করে পড়তে লাগলো।
হঠাৎ করে ঝড়ো হাওয়ায় জানালাটা পাশের দেয়ালে ধাক্কা লেগে একটা গ্লাস ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়তেই আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল। সম্বিৎ ফিরে পেলাম। শরীরে তখন বেশ জ্বর। রুমটা পুরো অন্ধকার, কখন যে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল টের পাইনি। একটা মেছের কাঠি জ্বালিয়ে টেবিল ল্যাম্পটা ধরালাম। দেখি এতদিন বন্ধ ঘরে বেড়ে উঠা একটা স্বাস্থ্যবান আরশোলা মনের আনন্দে এন্টিনা নেড়ে নেড়ে পাউরুটিটা চুকছে! আর খাওয়ার ইচ্ছে রইল না। ঢক্ ঢক্ করে দুগ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
আমার রুমমেট দরজায় একটা ছোট্ট ঘন্টা লাগিয়েছে। যাওয়া আসার সময় পর্দার ধাক্কায় ঘন্টার টুন টুন শব্দটা তার খুব পছন্দ! দুপুরে ঘুমের অসুবিধা হলেও কিছু বলি না। ধীরে ধীরে সয়ে গেছে।
একটু আগে টুন টুন শব্দটা টুনির পায়ের নূপুর নয় বরং দমকা হাওয়ায় দরজার ঘন্টা বাজার শব্দ ছিল হয়ত, টুনির চিমটিটা আসলে ছিল মশার কামড় যা তখনও চুলকাচ্ছিল। জানালার পাশে ঝুলেথাকা মশারীর রশিটা সম্ভবত ছিল টুনির মাথার চুল যা গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। বাতাসের শো শো শব্দটা ছিল ফুফিয়ে ফুফিয়ে টুনির কান্নার মতই। হয়তবা বাতাসের সাথে দুএক ফোটা বৃষ্টিই ছিল টুনির চোখের জল আর বুকের উপর নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মাথার খুলির ফ্রন্টালবোনটাই ছিল টুনির মাথা যেথায় ছিল আমার শান্তনার হাত।
স্বপ্নের ঘোর তখনও কাটেনি। শরীর, মন এবং একাকীত্ব সব মিলিয়ে খুব খারাপ লাগছিল। এ মুহূর্তে টুনির যতœটার খুব অভাব অনুভব করছিলাম।
বারংবার মনে হচ্ছিলো টুনিকে নিয়ে আমার স্বপ্নটা খুব কষ্টের হলেও কেন যেন অনেক অনেক মধূর ছিল…।
এ যে ছিল অন্যরকম এক অনুভূতি।