সামনে পিছনে বিভিন্ন রঙের পালের নৌকার সমাহার কত যে অপরূপ, কত যে সুন্দর সচক্ষে না দেখলে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। এরকম নান্দনিক সৌন্দর্য বাংলাদেশের নদীর গতি প্রকৃতি এবং ভৌগলিক কারণেই এ অঞ্চলটাতে এমনভাবে ফুটে উঠেছে

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

‘প্রতিদিনই উঠে নূতন সূর্য প্রতিদিনই আসে ভোর’। জীবনের প্রতিটা দিন বৈচিত্রময়। একেকটা সকাল, দুপুর, বিকেলও নিঃসন্দেহে একেক রকম। সাথে সাথে দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রকৃতির মত হয়ত মানুষের মনটাও। উল্টোদিকের শারদীয় মৃদু বাতাস, নৌকা চলার ছলাৎছলাৎ শব্দ, আকাশে ক্ষুধার্ত পাখির কিচিরমিচির, নদীতীরে ভাদ্র মাসে কুকুরদলের ঘেউ ঘেউ, চোখের পাতায় উদীয়মান সূর্যালোকের উষ্ণ পরশ, সব মিলিয়ে স্বপ্নময় প্রশান্তির ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। দেরি করে ঘুমানোর ফলে মনে হয় চাচা এতক্ষণ ডাকছিলেন না।
গুণের নৌকা কিছুটা আড়াআড়ি করে রাখতে হয়। নদীর তীর থেকে আড়াআড়িভাবে গুণটানা আর নৌকার পজিশন এ দুয়ের সমীকরণেই নৌকা নদী বরাবর তথা সোজা হয়ে চলে। এখানে জ্যামিতি কাজ করে। শুধু তাই নয়, পালের নৌকায় মাস্তুলের রশি টেনে নৌকার বিভিন্ন স্থানে বাঁধা, বাতাসের গতিবেগ চিন্তা করে পালের কোন্ কোণের রশি কতটুকু লম্বা থাকবে, কোথায় বাঁধতে হবে এখানেও জ্যামিতি বিদ্যমান। ঠিক এমনি করে নৌকার আকার অনুযায়ী হালের আকার ও ডিজাইন কেমন হবে, কিভাবে ধরতে হবে সেখানেও নিখুঁত হিসেব আছে বৈ কি। বাংলার রূপ বৈচিত্র উপভোগের সাথে সাথে দক্ষ নাবিকের মত এসব খুঁটে খুঁটে দেখার মাঝেও অনেক মজা পাচ্ছিলাম। নিজেকে মনে হচ্ছিল যেন একজন ক্ষুদে সিন্দাবাদ অথবা কলম্বাস। প্রশস্ত মেঘনার তীরবর্তী একেকটা গ্রাম, নদীবন্দর, ভাসমান চর মনে হচ্ছিল আবিস্কৃত নূতন দেশ, নূতন কোন দ্বীপ।
রকমমামু রান্নার কাজ শেষ করে সবাইকে ডাকতে বললেন। তিন বেলাই ভাতের আয়োজন। টাটকা মাছভাজি আর পাতলা ঝোলের কারি সবাই বসে একসাথে খাওয়ার স্বাদ ও আনন্দ নিঃসন্দেহে ভিন্নমাত্রা বহন করে।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই দাড় টানতে শুরু করলেন এই আশায় যে উত্তরীয় বাতাস বইতে পারে যেকোন সময়। শরতে মৌসুমি বায়ু প্রবাহের তীব্রতা কমার সাথে সাথে বর্ষার পানিও কমতে শুরু করে। বাতাসের তীব্রতা যেমন হ্রাস পায় তেমনি বায়ূর দিক পরিবর্তন ও ঘটতে থাকে ঘনঘন। কিছুক্ষণ পর বাতাস অনুকূলে বইতে লাগল। সবাই পাল টাঙ্গাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পালের নৌকার সুবিধা হল একদিকে বাতাস বইলে মোটামুটি তিনদিকে যাওয়া যায়। পরপর তিনটা পালই টাঙ্গানো হল।
উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান তথা সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অংশ বিশেষ থেকে ধান বোঝাই নৌকার সংখ্যা ভাটির দিকে অর্থাৎ গৌরিপুর, মতলব, হাজিগঞ্জ, মদনগঞ্জ, কাটপট্টি যাওয়ার পথে মেঘনার এ প্রশস্ত অঞ্চলে অনেক বেড়ে গেল। এখান দিয়েই সবাইকে যেতে হবে। ভাটিতে যাওয়ার এটাই যেন একমাত্র প্রশস্ত গিরিপথ। তাই সামনে পিছনে বিভিন্ন রঙের পালের নৌকার সমাহার কত যে অপরূপ, কত যে সুন্দর সচক্ষে না দেখলে আন্দাজ করা সম্ভব নয় মোটেও। আর এরকম নান্দনিক সৌন্দর্য বাংলাদেশের নদীর গতি প্রকৃতি এবং ভৌগলিক কারণেই এ অঞ্চলটাতে এমনভাবে ফুটে উঠেছে। উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় নদীসমূহ তথা পদ্মা, যমুনা অববাহিকাতে গ্রাত বেশি যেটা হাওর বিধৌত অত্রাঞ্চলের স্বচ্ছ জলরাশিতে নেই। তাই এখানে নেই দেশের পশ্চিমাঞ্চলের মত তেমন নদী ভাঙ্গন, নেই নদীপাড়ের মানুষের হাহাকার। মনে হচ্ছিল সম্পদ, সম্পত্তি গ্রাস নয় বরং এখানে ব্যবসা, বাণিজ্য, জলমহাল, বালুমহাল, মাছ, ফসল প্রকৃতির তরফ থেকে এসব হচ্ছে অত্রাঞ্চলের মানুষের জন্য এক বিশেষ দান, বিশেষ আশীর্বাদ। একটা ছোট্ট দেশে প্রকৃতিগত এমন বৈষম্য বা পরিবর্তন পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
পালের ছায়া ছইয়ের উপর পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে। রকমমামু ছাড়া সবাই আড্ডায় মগ্ন। আমি শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের দু’তিন খন্ড হাতে নিয়ে উপরে উঠলাম। বিভিন্ন খন্ড থেকে রামের সুমতি, মামলার ফল, বিন্দুর ছেলে, অভাগীর স্বর্গ ছোটগল্পগুলো এক এক করে শুনাতে লাগলাম। সবাই দারুণ মজা পেতে লাগলেন। আমার পড়ে শুনানোর আগ্রহও বেড়ে গেল দ্বিগুণ। শরৎ রচনাবলীর বৈশিষ্ট্য হল এই যে বিভূতিভূষণের লেখার মতই শুরু করলে শেষ না করে উঠার সাধ্যি নেই। তাদের সাথে সাথে আমারও শরৎ বাবুকে জানা ও উপলব্ধির একটা মোক্ষম সুযোগ হল। এ মুহূর্তে আমি না থাকলে হয়তবা সবাই লুডু খেলতেন। নিচ থেকে মাংস রান্নার পাঁচপোড়ণের গন্ধে পাকস্থলীতে হাইড্রক্লোরিক অম্লের মাত্রাধিক্য জানান দিল খাওয়ার সময় আসন্ন।
সবাই নেমে রকমমামুকে সহযোগিতা করতে লাগলেন। নাদুচাচা নৌকার সামনদিকে নজর রাখছিলেন, আর চাচা হাল ধরেছিলেন। আমরা বাকি ছ’জন খেতে বসলাম। তৎসঙ্গে পড়াশোনা না করা নিয়ে উনাদের মাঝে নানা খুনসুটি সহ এতক্ষণ শোনা শরৎ ছোটগল্পসমূহের মধুর জাবরকাটাও চলছিল নির্বিকার চিত্তে।
চলবে…