মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ পবিত্র লাইলাতুল মিরাজ আজ। যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশে আজ ২৬ রজব, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সারা দেশে পবিত্র লাইলাতুল মিরাজ পালিত হবে। পবিত্র এই রাতে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) মিরাজ গমন করে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হিজরি সনের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে লাইলাতুল মিরাজ পালন করেন। ইসলামে এই রাতকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
মিরাজের রাত ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া কবুলের রাত হিসেবে গণ্য করা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির-আজকারের মধ্য দিয়ে রাতটি পার করে থাকেন। অনেকে পবিত্র মিরাজে নফল রোজা রাখেন। দান-সদকাও করেন। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ এবং মসজিদুল আকসা থেকে সাত আসমান পেরিয়ে আরশে আজিম সফরকে ‘মিরাজ’ বলা হয়। ইতিহাসের নিরিখে নবুওয়াতের দশম বছর ৬২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ রজব দিবাগত রাতে মহানবী (সাঃ) আল্লাহ্র সান্নিধ্যে মিরাজ গমন করেন। পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ঈসরাইল ও সূরা নজমের আয়াতে, তাফসিরে এবং সব হাদিস গ্রন্থে মিরাজের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। পবিত্র এই রাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর সঙ্গে নবীজী প্রথমে বায়তুল্লাহ শরীফ থেকে বোরাকে চড়ে বায়তুল মুকাদ্দাস গমন করেন। সেখানে হযরত আদম (আঃ) সহ অন্যান্য নবীদের নিয়ে মহানবী (সাঃ) দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। তারপর সেখান থেকে তিনি এই রাতেই সপ্তম আকাশ পেরিয়ে সিদরাতুল মুনতাহায় উপনীত হন। এরপর রফরফ নামক বাহনে চড়ে আল্লাহ্র প্রিয় হাবিব মহান প্রভুর অনুগ্রহে আরশে আজিমে পৌঁছেন। আল্লাহ্ তায়ালার দিদার লাভ ও সরাসরি কথোপকথন শেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করেন প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)।
পবিত্র শবে মেরাজ: ঘটনা বিশ্লেষণ ও করণীয় ঃ নবুওয়াতের একাদশ বছর ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। যে বছর হযরত মুহাম্মদ সা. কে এক সম্মানজনক রাত উপহার দেয়া হয়। যা নবীদের মধ্যে শুধুমাত্র মহানবী সা.’র বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
এক রাতে মহানবী সা. হাতিমে কাবায় শুয়েছিলেন। বুখারী শরীফের এক বর্ণনানুযায়ী তিনি নিজ ঘরে শুয়েছিলেন। হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল আ. এসে বললেন- আমাদের সাথে চলুন। বোরাক নামীয় স্পেশাল সওয়ারীর উপর আরোহণের মাধ্যমে পবিত্র এ শোভাযাত্রার সূচনা হয়। এই বোরাকের দ্রুতগামীতার অবস্থা এই ছিল যে, যেখানে তার দৃষ্টিশক্তি পড়ছিল, সেখানেই সে পা ফেলছিল। এভাবে বিরতিহীন যাত্রার পর প্রথমে তাঁকে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে আল্লাহতায়ালা আগে থেকেই পূর্বেকার সকল আম্বিয়ায়ে কেরামকে সমবেত করে রাখেন তাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য। এটা শুধুমাত্র বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.’র একক বৈশিষ্ট্য।
মসজিদে আক্বসায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি এভাবে সাজানো ছিল- প্রথমে হযরত জিবরাঈল আ. আযান দিলেন এবং নামাজ আদায়ের জন্য সকল নবী-রাসূল কাতারবন্দী হয়ে অপেক্ষমান ছিলেন যে কে নামাজের ইমামতি করবেন। হযরত জিবরাঈল আ. বিশ্বনবীর হাত ধরে ইমামতির জন্য এগিয়ে দিলেন। তিনি ইমাম হয়ে সকল নবী-রাসূল ও ফেরেস্তাদের নামাজ পড়ালেন। তিনি হলেন ইমামুল মুরসালিন। এ ছিল পৃথিবী জগতের ভ্রমণ যা রফরফ বোরাকের দ্বারা সম্পন্ন হয়। অতঃপর তাকে আল্লাহর নির্দেশে পর্যায়ক্রমে আসমানসমূহে ভ্রমণ করানো হয়।
প্রথম আসমানে: হযরত আদম আ.’র সাথে, দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা আ.’র সাথে, তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ আ.’র সাথে, চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস আ.’র সাথে, পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন আ.’র সাথে, ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা আ.’র সাথে, সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহিম আ.’র সাথে সাক্ষাত হয়। (বুখারী শরীফ, ফাতহুল বারী: পারা ১৫/পৃ.৪৮৫)
অতঃপর তিনি ‘সিদরাতুল মুনতাহার’ দিকে সফর শুরু করেন। পথিমধ্যে হাউজে কাউসার অতিক্রম করেন। পরে তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি খোদায়ি সব নিয়ামতের দর্শন লাভে সক্ষম হন। জান্নাতে থাকা স্পেশাল সব নেয়ামত দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেন। যা কোনো চোখ আজ পর্যন্ত দেখেনি, কোনো কান শুনেনি এবং কোনো মানুষের কল্পনা শক্তিও সে পর্যন্ত পৌঁছেনি। এরপর তাঁর সামনে হাজির করা হয় জাহান্নাম। যা ছিল সর্বপ্রকার আযাব-গযবে ভরপুর। তাতে তিনি একদল লোককে দেখলেন যারা মৃত জন্তুর গোশত খাচ্ছে। প্রশ্ন করলেন এরা কারা। উত্তরে জিবরাঈল আ. বললেন, এরা আপনার উম্মতের সেসব লোক যারা দুনিয়াতে নিজ ভাইদের গোশত খেত অর্থাৎ গীবত করত। এরপর দোযখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।
সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত হযরত জিবরাঈল আ. ছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী। এরপর হযরত নবীয়ে করীম সা. এহান প্রভুর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মাহবুবে খোদা, সরদারে দুআলম আল্লাহ তালার দর্শনে মনোনিবেশ করেন। এ দর্শন শুধু আন্তরিক ছিল না বরং চক্ষু দর্শনই ছিল। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এবং সকল সাহাবায়ে কেরাম ও ইমামগণের এ অনুসন্ধান। সেখানে মহানবী সা. এহান সৃষ্টিকর্তার কুদরতি পায়ে সেজদায় পড়ে যান। মেরাজ রজনীর এ রাতে আল্লাহতায়ালা উম্মতে মুহাম্মদিকে স্পেশাল গিফট হিসেবে নামাজ দিয়েছেন। তাই নামাজকে বলা হয় মুমিনের মেরাজ। প্রভাতের আগেই কল্যাণময় এ সফরের সমাপ্তি ঘটে।
আল্লাহর হুকুম পালনই পুরো দ্বীনের সারাংশ: পুরো দ্বীনের সারাংশ মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র এ বাণী-‘তোমরা আল্লাহর হুকুম মানো’। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যখন যে ইবাদতের হুকুম করেছেন, তখন তা আদায় করাই হল আল্লাহর হুকুম পালন করা। আল্লাহ তাআলা যদি দয়া ও অনুগ্রহ করে এ বাস্তবতাকে আমাদের অন্তরে ঢেলে দেন তখনই এসকল বিদআতের মূলোৎপাটন হওয়া সম্ভব।
মাহে রজব রমজানের ভূমিকা, তাই রমজান আসার আগেই প্রত্যেকে সিয়াম-সাধনার প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। এ জন্যই মহানবী সা. রজব মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই এই দুআ করতেন-‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শা’বান, ওয়া বাল্লিগনা রামাজান’ অর্থাৎ হে আমার প্রভু! আপনি আমাকে রজব-শা’বানে বরকত দান করুন। এবং এ বরকত সাথে নিয়ে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।