জালাল আহমেদ
‘আসামী আসামী জেলতুতো ভাই!’

মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট এর কাজে বুঝে উঠার কোন সময় বা ওরিয়েন্টেশনের সুযোগ নাই। প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় পুরোদমে কাজ। এটা ঠিক যে ‘স্লো থ্রটল’ এর কিছু সুযোগ রয়েছে কারণ প্রথম দিকে বিচার ফাইলের মামলাগুলো নিজের বিচার ফাইলে গ্রহণ করে পরবর্তী তারিখ দেয়ার মাঝে একটা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ হয়। কিন্তু সিএমএম সাহেব যদি জেনারেল ফাইল বা পুলিশ ফাইল দেয়া শুরু করেন তাহলে সেই সুযোগও সীমিত হয়ে আসে। মতিউর রহমান সাহেবের একটা অভ্যাস ছিল প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে এমএমদের নিয়ে দীর্ঘ আড্ডা দেয়া। এই দীর্ঘ আড্ডার মূল বিষয়ই ছিল সপ্তাহের পূর্ববর্তী দিনগুলোর অভিজ্ঞতা শেয়ার ও বিশ্লেষন। এটা ম্যাজিস্ট্রেসির জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল এবং সিএমএম সাহেবের অভিজ্ঞতার ভাগ পাবারও সুযোগ ছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি যে ৫ জন ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে শুরু হয় এস এম মতিউর রহমান ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি ৭৮-৮৩ এই পাঁচ বছর ঢাকার মেট্রোপলিটিন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকার অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি কাজ করেছেন ঢাকা’র অন্যতম খ্যাতনামা সিএমএম জেড এ শামসুল হকের সংগে। তাঁর দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন ম্যাজিস্ট্রেসির অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। পরবর্তীতে আমরা প্রতি বৃহস্পতিবারে নিয়ম করে একত্রে সিআরপিসি ও সাক্ষ্য আইন পড়তে শুরু করি যা আমাদের জানার পরিধিকে আরো বাড়াতে সাহায্য করে।
স্বৈরাচারের পতনের পথ ধরে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমনের মূল দায়িত্ব ছিল জাতীয় সংসদের একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা। সেই উদ্দেশ্যে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। যথাযথ প্রস্তুতির পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সব পূর্বানুমান ভুল করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ১৪৪টি আসন লাভ করে, আওয়ামী লীগ পায় ৮৮টি আসন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসে যে আওয়ামী লীগ বিজয় সম্পর্কে এত নিশ্চিত ছিল যে নির্বাচনের দিন অপরাহ্ন থেকে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ মন্ত্রিসভায় নিজেদের আসন নিশ্চিত করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সন্ধ্যার পর থেকে যখন টিভিতে নির্বাচনের সংবাদ আসতে শুরু করে তখনই বুঝা যায় যে ফলাফল ভিন্ন কিছু হতে যাচ্ছে। আমরা সারারাত জেগে নির্বাচন সংবাদ দেখতে থাকি এবং বিএনপি’র অপ্রত্যাশিত বিজয় প্রত্যক্ষ করি। বিএনপি নিজেও অপ্রস্তুত ছিল এবং সে অবস্থায়ই নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
আমি আগে উল্লেখ করেছি যে আমার ছোটবেলা কেটেছে চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার সিএন্ডবি কলোনীতে। কলোনীর প্রথম বিল্ডিংয়েই আমরা থাকতাম, দোতলায়। খুব বেশি স্মৃতি নেই সেই এলাকার বা সময়ের। আমাদের বিল্ডিং এর পাশেই ছিল একটা প্রাইভেট বিল্ডিং, তিন বা চার তলা, তার পাশে সারি বাঁধা নারিকেল গাছের কথা মনে পড়ে। আমার স্কুলের শুরু ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামেই, জামালখানের সেইন্ট মেরী স্কুলে। ৩০ বছর পর ১৯৯৪ সালে আমার বড় ছেলেও একই স্কুলে তাঁর লেখাপড়া শুরু করে।
মনেপড়ে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা। রাতে যেন বাইরে আলো না যায় এজন্য জানালার কাঁচের উপর কালো কাগজ সাঁটা, বিমান আক্রমণ হলে বোমা বর্ষণ হলে গ্লাস ছিটকে যেন কেউ আহত না হয় সে জন্য কাঁচের উপর টেপ সাঁটানো এইসব। আমাদের বিল্ডিং এর সামনে, আসলে সব বিল্ডিং এর সামনেই ডাব্লিউ শেপের ট্রেঞ্চ কাটা হয় বিমান আক্রমণ হলে আশ্রয় নেবার জন্য। এয়ার রেইড প্রিকশন (এআরপি) এর ওয়ার্ডেন এয়ার এ্যাটাক ড্রিলও করানো হয়।
যে স্মৃতি খুব বেশি করে মনে পড়ে তা হলো ১৯৬৫/৬৬ সালের একটি সাইক্লোন। ঐদিন আব্বা অফিস থেকে দুপুরবেলা বাসায় এসে একটা লম্বা স্টিক দিয়ে ফ্লোর হাইট মাপছিলেন। আসলে স্টিক দিয়ে মাপার প্রয়োজন ছিল না কিন্তু আমার আব্বা’র একটা অভ্যাস ছিল যাই করবেন তা নিখুঁতভাবে করার, তাই তিনি ফ্লোর হাইট মাপছিলেন স্টিক দিয়ে। আমার এক দূর সম্পর্কের চাচার দোকান ছিল একটু নীচু এলাকায়, তিনি কিছু দামী জিনিস নিয়ে আশ্রয় নিলেন আমাদের সরকারি বাসায়। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অত ভাল ছিল না। টিভি শুধু ঢাকাতে চলে দিনে কয়েক ঘন্টার জন্য, ফলে রেডিওর খবর আর মাইকিং ভরসা। বিকেলের দিকে পানি বাড়তে শুরু করলো। ড্রেন দিয়ে এবং প্রধান সড়ক থেকে কলোনীর দিকে যে রাস্তা আসছিলো তার পাশের খাল দিয়ে পানি উজানে আসছিল প্রবল স্রোতের সংগে। আব্বা দুপুরে যে কারণে ফ্লোর হাইট মাপছিলেন এখন বুঝি যে তিনি জলোচ্ছাসের উচ্চতার সংগে আমাদের নিরাপদ থাকার কথা চিন্তা করছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকেই বাতাস বাড়তে থাকে আর সারারাত চলে ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব। আমি যখন ১৯৮৮-১৯৯০ বাঁশখালি উপজেলায় ইউএনও ছিলাম তখনো বৎসরে দু’বার ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে প্রাক প্রস্তুতি নিয়েছি।
১৯৯১ এর এপ্রিল মাসেও যখন ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা প্রকাশ করে আবহাওয়া বুলেটিন প্রচার করা শুরু করলো, সাধারণ মানুষ কেন, আমরাও খুব গুরুত্বের সংগে নেইনি। এর অন্যতম কারণ ছিল ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৮৫ সালে উড়িরচর ছাড়া আমাদের উপকূলে বড় কোন ঘূর্ণিঝড় হয়নি। ফলে নবনির্বাচিত সরকারও ছিল অপ্রস্তুত। প্রচার ছিল কম আর মানুষ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমরাও যে গুরুত্বের সংগে নেইনি তার আরেকটি প্রমাণ হল ওইদিন দুপুরের পর আমার একটি টি আই প্যারেড বা টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড ছিল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। টি আই প্যারেড হল পুলিশের তদন্ত কাজের একটি অংশ, কোন কোন মামলায় এটির প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে ডাকাতির মামলায় যদি লেখা থাকে যে ‘আসামী দেখিলে চিনিব’, তাহলে ধৃত আসামীকে বাদী বা সাক্ষী/সাক্ষীদের মুখোমুখি করা হয় সনাক্তকরণের জন্য। এ বিষয়ে বিস্তারিত নিয়ম কানুন পিআরবি বা পুলিশ রেগুলেশন অফ বেংগল ১৯৩৩ এ লিপিবদ্ধ ছিল। এজন্য ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতির প্রয়োজন হয়। সাধারণতঃ একজন আসামীর জন্য কাছাকাছি বয়সের ও শারীরিক গঠনের আরো ৯/১০ জন আসামীকে একসারিতে বসানো হয়, তখন সাক্ষী তাদের দেখার সুযোগ পায় না। তারপর সাক্ষীকে এনে তাদের সামনে হাঁটানো হয়। কাউকে যদি সাক্ষী ঘটনার আসামি বলে মনে করে সাধারণতঃ অঙ্গুলীনির্দেশে তাঁকে সনাক্ত করে। মজা হল টি আই প্যারেডে লাইনে বসা সকলের চেষ্টা থাকে সাক্ষীকে বিভ্রান্ত করার, ‘আসামী আসামী জেলতুতো ভাই!’। তো ঐদিন বিকেলে আমি যাই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং যথারীতি তা সমাপ্ত করে বাসায় ফিরে আসি।