শিক্ষাবিদ আব্দুল হান্নান চৌধুরী স্মৃতি বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে মেয়র মিজানুর রহমান

ফয়সল মাহমুদ ॥ হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোঃ মিজানুর রহমান মিজান বলেছেন- প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও আদর্শ মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখা উচিত। সমাজে আদর্শ মানুষের বড়ই অভাব। তাই আদর্শ মানুষের সংখ্যা বাড়লে সমাজ দেশ ও রাষ্ট্র উপকৃত হবে। তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, প্রত্যেকের ছেলেমেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়েদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুললে পরিবারে সুখ-শান্তি আসবে। গতকাল বুধবার সকালে হবিগঞ্জ বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে বৃহত্তর সিলেট তথা হবিগঞ্জের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং হবিগঞ্জ হাই স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুল হান্নান চৌধুরী স্মৃতি বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
মেয়র মিজান আরো বলেন- শিক্ষাবিদ আব্দুল হান্নান চৌধুরী একজন আপাদমস্তক খাটি আদর্শ মানুষ ছিলেন। তাঁর স্মরণে প্রতি বছর বৃত্তি প্রদান করায় মরহুমের ছেলে সুইডেন প্রবাসী আব্দুল বাছিত চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মেয়র মিজান। তিনি এ বৃত্তি অব্যাহত রাখার জন্য বাছিত চৌধুরীর প্রতি আহবান জানান।
দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ সম্পাদক হারুনুর রশিদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুল কবির ও হবিগঞ্জ টিভি জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাহিজ। অনুষ্ঠানে বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ বক্তৃতা করেন। শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন হবিগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্দুল কবির বলেন- শিক্ষার্থীদেরকে মা-বাবার কথা শুনতে হবে। গুরুজনদের সম্মান করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্কুলের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে দুই হাজার টাকা করে বৃত্তি প্রদান করা হয়।
প্রসঙ্গত, মরহুম আব্দুল হান্নান চৌধুরীর ছেলে সুইডেন প্রবাসী কমিউনিটি লিডার আব্দুল বাছিত চৌধুরীর আর্থিক সহায়তায় প্রতিবছর এই বৃত্তি প্রদান করা হয়ে থাকে।
মরহুম আব্দুল হান্নান চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনী ঃ আব্দুল হান্নান চৌধুরী ১৯২১ সালে হবিগঞ্জের দরিয়াপুর গ্রামে একটি শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ডাঃ আব্দুল মান্নান চৌধুরী (আসামের ডিব্রুগড় থেকে ডাক্তারী পাশ করেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মাতার নাম সৈয়দা খায়রুন্নেছা, মাতুলালয় ফকিরাবাদ। সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালারের ভ্রাতা সৈয়দ শাহ ইয়াকুবের উত্তরাধিকারী।
উল্লেখ্য, তার পিতামহ আব্দুল কাদির চৌধুরী (১৮৫৩-১৯৪১) আসাম পুলিশ সার্ভিসে কর্মরত অবস্থায় ১৯১১ সালে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ মোহাম্মদ আমিন চৌধুরী লস্করপুর দেওয়ানী আদালতের মুন্সেফ বা বিচারকের পদ লাভ করেন।
আব্দুল হান্নান চৌধুরী প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে। নবকুমার ইনস্টিটিউট ছিল ঢাকার স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। আব্দুল হান্নান চৌধুরী ১৯৩৯ সনে করিমগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪১ সালে রাজশাহী গভর্ণমেন্ট কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এম এ পড়াশোনা করেন ১৯৪৪ সালে। শিক্ষকতা করার সময়ে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি (১ম শ্রেণীতে ৪র্থ) ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি তার চাচা প্রিন্সিপাল আব্দুর রব চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে থেকে পড়াশোনা করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে আব্দুল হান্নান চৌধুরী বৃটিশ বিমান বাহিনীতে এরোড্রাম অফিসার হিসেবে করিমগঞ্জের পাথারকান্দি এয়ারপোর্টে কাজ করেন। তিনি সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে সুরমা ও বরাক ভ্যালীর ভাঙ্গা, বদরপুর প্রভৃতি স্থানে চাকুরী করেছেন। ১৯৪৬ সালে কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি গভর্ণমেন্ট হাই স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সনে তিনি আসাম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু দেশবিভাগ এবং রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সিলেট জিলা বিভক্ত হয়ে বৃহদাংশ পাকিস্তানে এবং করিমগঞ্জসহ একাংশ আসামে অন্তর্ভূক্তির ফলে অন্য অনেকের মতো তারও ইএসি পদে চাকুরী লাভ সম্ভব হয়নি। দেশ বিভাগের শর্তানুযায়ী তিনি পাকিস্তানে অপশন দিয়ে মৌলভীবাজার গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে যোগ দেন। তারপর হবিগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে বদলি হন।
১৯৬০ সনে আব্দুল হান্নান চৌধুরী শিক্ষা বিভাগের অধীনে সহকারি স্কুল পরিদর্শকের চাকুরিতে যোগদান করেন। তিনি জামালগঞ্জ, সিলেট, বগুড়াসহ বিভিন্ন স্থানে এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে কাজের মূল্যায়ন ও দক্ষতাবলে তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার জেলা স্কুল পরিদর্শক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর এলাকাবাসীর অনুরোধে তিনি হবিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমানে হবিগঞ্জ হাইস্কুল এন্ড কলেজ) অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি অত্যন্ত সততা ও সুনামের সাথে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করেন। প্রায় বছর তিনেক দায়িত্ব পালন করার পর পুরোপুরি অবসরে যান।
২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রায় ৮৭ বছর বয়সে এই মহান ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুকালে ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে যান।
স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি হবিগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। বৃহত্তর সিলেটের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার নেতৃত্বের ছোয়া রয়েছে। এককথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন প্রকৃত শিক্ষানুরাগী, কর্মঠ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত সাদাসিদে চলাফেরা করতেন। সমাজসেবায় তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।