জালাল আহমেদ
যদি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না থাকে তবে সবই মিথ্যা, তার যদি টাকাই না থাকে তাহলে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া গেলেও তার লাভ নেই

একবছর আগে জানুয়ারী মাসেই বিএমএ ট্রেনিং এ যোগ দিয়েছিলাম, আবারো শীতকাল, আবারো একই ধরণের রুটিন। ভোর ৪ঃ৩০ টায় প্রচন্ড শীতের মাঝে শয্যা ত্যাগ, সহজে কি হয়? বাইরে দরজার পাশেই প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংগানী এলার্ম বাজে, চটপটে বুদ্ধিমান কেউ দু’একদিনের মধ্যেই দিলো সেই এলার্ম অকেজো করে। তারপর শুরু হলো বারান্দায় হেঁটে হেঁটে ঘন্টা বাজানো। আর এড়ানোর উপায় নেই! সকালে প্রথম কাজ হাঁটা বা দৌড়ানো, কখনো জাহাঙ্গীরনগর পর্যন্ত, ফিরে এসে পিটি। রুমে ফিরে শেভ-গোসল সেরে ছুটে গিয়ে নাস্তা করা তারপর ক্লাস। বর্তমান ডাইনিং ছিল আমাদের ক্লাশ রুম। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের পর ঘুম চোখে ক্লাস। ঘুম তাড়ানোর জন্য কত রকম কসরত যে সবাইকে করতে হতো। তার মধ্যে অন্যতম ছিল চিরকুট চালান। কেউ একটা কিছু লিখে পাস করে দিল পরের জনের কাছে, তারওপর মন্তব্য, উপরি-মন্তব্য চলতে লাগলো। পাশের জন কখনো দায়িত্ব পালন করতো ঘুম তাড়ানোর। আর প্রশিক্ষকের চেষ্টা তো ছিলই।
ড. আকবর আলি খান পড়াতেন বাংলাদেশ চর্চা, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তিনি ব্যতিক্রমী পন্ডিত মানুষ, আমার মেন্টর, দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন ধরণের। আগেই উল্লেখ করেছি যে তাঁকে দেখেই আমার সিভিল সার্ভিসে আসা, তিনিও তা জানতেন। তিনি ক্লাসে বিতর্ক উস্কে দিতে পছন্দ করতেন। তাঁর নিজের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিল, নিজস্বতাও ছিল। আমার সঙ্গে ক্লাসে লেগে গেল “সোনার বাংলা” নিয়ে। আমরা প্রায় সবাই সোনার বাংলায় বিশ্বাস করি, গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের গল্প শুনেছি। তিনি বলতেন তা ছিল মিথ! যদি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা না থাকে তবে সবই মিথ্যা, তার যদি টাকাই না থাকে তাহলে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া গেলেও তার লাভ নেই। তিনি ক্লাসে স্লাইড-প্রজেক্টরে যা দেখাতেন মুখে সেটা বলতেন না, আর হ্যান্ড আউট দিতেন আরো ভিন্ন কিছু। ফলে এক ক্লাসেই প্রায় তিন রকম দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়ে যেতো। অসাধারণ প্রজ্ঞা তাঁর!
ড. এটিএম শামসুল হুদা পড়াতেন লোক প্রশাসন বা পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন। তিনি ভদ্রলোক, মৃদুভাষী এবং নিজের চাকুরী জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাঁর উপস্থাপনায় নিয়ে আসতেন। ড. হারুনুর রশিদ পড়াতেন তাত্ত্বিক অর্থনীতি। তিনিও ছিলেন মৃদুভাষী এবং তাঁর পাড়ানোর স্টাইল ছিল একেবারে নীরস, কাঠখোট্টা। এমনিতেই যারা অর্থনীতির ছাত্র নয় তাদের জন্য অর্থনীতি পড়ানোর ধরনটা আলাদা হওয়া উচিত কিন্তু তিনি একটানা পড়িয়ে যেতেন প্রশিক্ষণার্থীদের প্রতিক্রিয়ার দিকে না তাকিয়েই। তাঁর বিষয়ে একবার ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল প্রশিক্ষণের শেষ দিকে। ড. এম এ জলিল ছিলেন একজন এমডিএস, তিনিও অর্থনীতি পড়াতেন। পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন হীরালাল বালা, আফতাব উদ্দিন, মোশারফ হোসেন ও আমাদের কোর্স পরিচালক মু আ মজিদ। আর কিছু ভুলে গেলেও মু আ মজিদ এর ভয়ঙ্কর পেচানো সই এর কথা কোনদিন ভুলব না। জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি কোথাও তাঁর সই জাল হওয়া আর তজ্জনিত সমস্যার কথা বলছিলেন। আমার সই সহজ, ৩৭ বছরের চাকুরী জীবন এই সহজ সই নিয়েই বিনা বিপদে পার করেছি যদিও বিভিন্ন বিপদজনক পদেও কাজ করতে হয়েছিল। তবে পরামর্শ হল সই অবশ্যই সহজে নকলযোগ্য হবে না। পেশাদার লোকজন যে কোন সইই নকল করতে পারবে, তাদের ঠেকানো যাবে না। কিন্তু যে কেউ যেন সই নকল করতে না পারে সেটা খেয়াল রাখা জরুরি।
বিকেলে খেলাধুলা ছিল। আমাদের খেলাধুলা বিকেল বেলা হতো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে। আমরা ছিলাম চার গ্রুপ, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলী। দুই গ্রুপ ফুটবল খেললে অন্য দুই গ্রুপ বাস্কেটবল খেলতো, এভাবেই খেলা চলত। ফুটবলে আমাদের টিম ভালো ছিল এবং আমি দলে নিয়মিত ছিলাম। খেলতাম রাইট উইং এ, উইংগার এর যে কাজ, গোলের জন্য বল বানিয়ে দেয়া, তাই করার চেষ্টা করতাম। আমি ছিলাম ‘একপেয়ে’ খেলোয়াড়, বাম পা ভালো চলতো না। তারমাঝে দু’একটা গোলও করেছি, চোখ চেয়ে দেখার মত একটা গোলও করেছিলাম যার ভিডিও ধারণ করা গেলে ১৯৮৫ এর সেরা গোলের পুরস্কার পেয়ে যেতে পারতাম। মাঠে যাবার আগে অনেক সময় ডরমিটরির সামনে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমরা গা গরম করতাম। এমনই গা গরমের প্র্যাকটিসে আমি দাঁড়িয়েছি গোলে আর আমার বন্ধু নজিব পেনাল্টি শট নিচ্ছে। একটা শট সে প্রচন্ড জোরে নিল, যা সোজা আমার পেটের দিকে আসছিল, আমি ডান হাত দিয়ে তা ঠেকানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু একটু সফট হ্যান্ড হওয়ায় আমার কব্জি মোচড় খেয়ে গেল। আমাকে কেন্দ্রের ক্লিনিকে দেখিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। এক্সরে করা হল, বলা হল ‘স্প্রেইন’, হাত ঝুলিয়ে দেয়া হল স্লিং এ, এবং দুই সপ্তাহ হাতের বিশ্রাম। ভাগ্যিস এটা ঘটেছিল ট্রেনিং এর শেষ দিকে, ফলে বড় ধরনের কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মূল অসুবিধা হচ্ছিল এই হাত নিয়ে লিখতে পারছিলাম না।
এরমাঝে একদিন অর্থনীতির এক পরীক্ষা। প্রশিক্ষণার্থীদের কেউই প্রস্তুত ছিল না ঐ পরীক্ষার জন্য। আমি তো না ই কারণ আমি ভেবেছিলাম আমারতো হাত ঝুলানো বলে পরীক্ষা দিতেই হবে না। ঐদিন পরীক্ষা নেবার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৮১ ব্যাচের Dr. Mohammad Tareque যিনি অর্থ সচিব ছিলেন ও বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের পক্ষে বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। ড. তারেক আসলেন পরীক্ষা নিতে আর সকল পরীক্ষার্থী একযোগে বলে দিল যে তাঁরা পরীক্ষা দেবে না। ড. তারেক কাগজপত্র গুছিয়ে চলে গেলেন আর আমরাও ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঘুরাফেরা করছি। তখন ঘটনাস্থলে হাজির হলেন ড. আকবর আলি খান। এসে সবাইকে রুমে ডাকলেন আর এরপর যে বকাঝকাটা করলেন তার কোন তুলনা নাই। এমনও বললেন যে জনপ্রশাসনে রিপোর্ট করে সবাইকে চাকুরীচ্যুত করাবেন অসদাচরণের দায়ে। বিধিমতে তিনি ছিলেন সঠিক কারণ আমরা সবাই ছিলাম শিক্ষানবীশ, চাকুরী স্থায়ীকরণের শর্ত হল বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করা। বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করতে ব্যর্থ হলে তো চাকুরী স্থায়ী হবে না।
জোঁকের মুখে চুন পড়ার মত সবাই যার যার সিটে গিয়ে বসলাম। তিনি বললেন যে এখনই পরীক্ষা হবে আর সবাই পরীক্ষা দিবে। তখন আমি একদম নিরীহ মুখ করে সামনে গেলাম, স্যারকে বললাম স্যার আমি তো পরীক্ষা দিতেই চাই, কিন্তু আমার হাত অকেজো, স্লিং এ ঝুলানো, লিখতে তো পারিনা! আকবর আলি খান বললেন যে সমস্যা নাই, তুমি ডিক্টেশন দিবে আর ড. তারেক লিখবে, একদম পেছনে গিয়ে বস। আমারতো আর কোন উপায় নাই, এদিকে সমস্যাও আছে, পরীক্ষার জন্য কোন প্রস্তুতিই আমার ছিল না। ড. তারেককে বললাম যে স্যার, আমার কিন্তু কোন প্রস্তুতি নাই, যাই বলি স্যার একটু গুছিয়ে লিখে দেবেন। আর গুছানো, আমি যা বলি ড. তারেক হুবহু তাই লিখেন, একটা দাড়ি কমাও যোগ বিয়োগ করেন নাই। তারেক স্যারকে এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও যখনই সুযোগ পেয়েছি এই কথা আমি মনে করিয়ে দিয়েছি।