এসএম সুরুজ আলী ॥ বাসায় বাসায় গিয়ে টিউশনি করে নিজের কষ্টের উপার্জিত টাকা দিয়ে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন হবিগঞ্জ শহরের শিরিন আক্তার সোনিয়া নামের এক তরুণী। টিউশনি থেকে উপার্জিত টাকায় শহরের মাহমুদাবাদ এলাকায় সোনিয়া ছোট টিনের ছাপটা ঘরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মায়ের মমতা অবৈতনিক বিদ্যালয় ও তার নিজের মা জহুরা খাতুনের নামে পাঠাগার। স্কুলে নিজের অর্থ দিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য বসার ব্রেঞ্চ ও পাঠাগারের বই ক্রয় করেছেন সোনিয়া। সোনিয়ার এমন উদ্যোগ অনেকেই মহতি উদ্যোগ বলে স্বীকৃতি দিলেও অর্থাভাবে স্কুলের পরিবেশের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতে ও মানসম্মত শিক্ষা, শিক্ষকদের সম্মানীও দিতে পারছেন না সোনিয়া। এ অবস্থায় তার গড়া স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত করতে সরকার ও সমাজের বিত্তশালীদের সহযোগিতা চেয়েছেন সোনিয়া।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হবিগঞ্জ শহরের মাহমুদাবাদ এলাকার নুরুল হকের কন্যা শিরিন আক্তার সোনিয়া ডিগ্রীতে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালের শেষে দিকে এলাকার ঝড়েপড়া ও দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে পড়ানোর জন্য মায়ের মমতা অবৈতনিক বিদ্যালয় গড়ে তুলেন। নিজের কোচিং পড়ানো থেকে উপার্জিত টাকা দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য টেবিল ও ব্রেঞ্চ ক্রয় করেন সোনিয়া। প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে বিদ্যালয়ের ঘর ভাড়া দেন সোনিয়া। এক পর্যায়ে সোনিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টির ঘরের ভাড়া মালিক বৃদ্ধি করলে তিনি থমকে যান। পরবর্তীতে সোনিয়ার তার বড় বোনের ১ শতক জায়গায় টিন দিয়ে ছাপটা ঘর তৈরি করে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম আবারও শুরু করেন। পাশাপাশি সেখানে মায়ের নামে গড়ে তুলেন পাঠাগার। পাঠাগারে অবসর সময়ে এলাকার বিভিন্ন বয়সের লোকজন বই পুস্তক পাঠ করতে আসেন। বিদ্যালয়ে সব বিষয়ে লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি, গান, বাজনা শেখানো ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা হয় শিক্ষার্থীদের। শুরুর দিকে সোনিয়া একা ৩০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করলেও আস্তে আস্তে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ১২০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তারা বিভিন্ন হাইস্কুল ও প্রাইমারী স্কুলে পড়ছেন। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে বিদ্যালয়ে এসে তাদের নিত্যদিনের স্কুলের পড়া শিখে যাচ্ছেন তারা। পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে ক্লাস করানো হয়। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের। তবে বিদ্যালয়টি নিচু টিনের হওয়ার কারণে গরমে শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে অবৈতনিক বিদ্যালয়টিকে আরো উন্নত করতে হবে। এতে প্রয়োজন হবে অনেক টাকা। কিন্তু এতো টাকা কোথায় পাবেন সোনিয়া।
বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে সোনিয়াসহ ৫ জন শিক্ষক পাঠদান করছেন। এর মধ্যে ৩ জন বেতন নিচ্ছেন না। আর এক শিক্ষকের সম্মানী হিসেবে সামান্য বেতন দিচ্ছেন সোনিয়া। শুধু ওই স্কুল নয়, শহরের আনোয়ারপুর এলাকায় আরেকটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেছেন সোনিয়া। সেখানেও ৫০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করানো হচ্ছে। সোনিয়া অন্যকে শিক্ষাদানের পাশাপাশি নিজেও শিক্ষা গ্রহণ করছেন। বর্তমানে তিনি সিলেট এমসি কলেজে মাস্টার্সে অধ্যয়ন করছেন। সোনিয়ার এ ধরণের শিক্ষা কার্যক্রমকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মাহমুদাবাদ এলাকার সুফিয়া আক্তার বলেন, আমার দুই মেয়ে সোনিয়ার স্কুলে পড়ছে। কিন্তু সে আমাদের কাছ থেকে কোন টাকা নিচ্ছে না। একবার আমি তাকে টাকা দিতে চাইলে সে বলে আমি দরিদ্রদের জন্য এই স্কুলটি করেছি। যাদের টাকা পয়সা নেই তারাই তার স্কুলে পড়তে আসছেন। তিনি বলেন, আগে এই এলাকার দরিদ্র পরিবারের ছোট বাচ্চারা আদব-কায়দা জানতো না। সোনিয়া মেয়েটি আমাদের আদব কায়দাও শিখাচ্ছে। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তা আজ শিখেছে তার দুই মেয়েসহ এলাকার সন্তানরা। এ জন্য আমরা সোনিয়ার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি এবং সোনিয়ার স্কুলটি যাতে প্রতিষ্ঠিত হয় এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। স্কুলছাত্রী সাফিয়া আক্তার সাবানা জানান, তার বাবা একজন চা বিক্রেতা। চা বিক্রি করে তার বাবার যে টাকা আয় হয় সেই টাকা দিয়ে তাদের কোনরকম সংসার চলে। এ অবস্থায় স্কুলে যাওয়া অনেকটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ খবর শোনে সোনিয়া তাকে বাসা থেকে নিয়ে এসে তার স্কুলে ভর্তি করান। বর্তমানে সাবানা ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ছে। সাবানা জানায়, দরিদ্র পরিবারের অনেক ছেলেমেয়েই সোনিয়া ম্যাডামের স্কুলে পড়ছে। অন্য স্থানে হয়তো তারা প্রাইভেট পড়লে বেতন দিতে পারতেন না। সোনিয়া শুধু তাদের পাঠদান করেন না, তিনি ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধ, মা-বাবাকে কিভাবে সম্মান করা যায় সেদিকে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেন। এছাড়াও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরেন বলে জানান সাবানা। তাছাড়াও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই, খাতাসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ দেন সোনিয়া। এলাকার কলেজ ছাত্রী শাবনুর আক্তার জানান, সোনিয়া আপা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় ওই স্কুলটি পরিচালনা করে আসছেন। তার এই মহতি উদ্যোগ দেখে স্কুলটির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হচ্ছে হয় আমার। এক পর্যায়ে আমিও স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। ওই স্কুল অনেকটা কিন্ডার গার্টেনের মতোই। শিক্ষার্থীরাও মেধাবী। আমার মত আরো অনেকেই এখানে পাঠদান করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
হবিগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মী কন্ঠশিল্পী আব্দুল আউয়াল জানান, একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সোনিয়ার স্কুলের কার্যক্রম দেখে আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি, এ স্কুলের কি কার্যক্রম। পরবর্তীতে সরাসরি গিয়ে স্কুলের ছিন্নমূল শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেখে আমি অবাক হয়েছি। সোনিয়ার এখানে যারা বিনামূল্যে পড়ছেন তাদের অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের। তাদের কারও বাবা রিকশাচালক, টমটম চালক ও শ্রমিক। এসব পরিবারের সন্তানরা সোনিয়ার স্কুলে লেখাপড়া করছে। তবে সোনিয়ার স্কুলটি আরো উন্নত হলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণ ও জ্ঞান অর্জন সমৃদ্ধ হতো। এ জন্য সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। সোনিয়ার মা জহুরা খাতুন জানান, সোনিয়ার ছোট বেলা থেকে দরিদ্র পরিবারের ছেলে মেয়েদের বিনামূল্যে লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন দেখতো। সে যখন এইচএসসি পাস করার পর ডিগ্রীতে ভর্তি হয়, তখন আমাকে ওই স্কুল করার পরিকল্পনার কথা জানায়। আমি তাকে প্রথমে বলছিলাম স্কুল পরিচালনা করতে গেলে অনেক টাকা খরচ করতে হবে। এর জবাবে সোনিয়া আমাকে জানিয়েছিল সেই টাকা সে প্রাইভেট পড়িয়ে উপার্জন করবে। এরপর আমি তাকে কোন বাঁধা দেইনি। স্কুল করতে তাকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করি। বর্তমানে সোনিয়ার স্কুল থেকে লেখাপড়া করে অনেক ছেলেমেয়ে বিভিন্ন হাইস্কুলে পড়ছে। সরকারি কিংবা কোন দাতা সংস্থার সহযোগিতা পেলে হয়তো তার স্কুলটি আরো উন্নত করা যেতো।
মাহমুদাবাদ এলাকার বাসিন্দা সেনাবাহিনীর অরসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট ফারুক মিয়া জানান, যখন সোনিয়া স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, তখন আমাদের পরামর্শ নিয়েছে। প্রথমে আমরা তাকে বলেছিলাম তুমি কি এই স্কুল চালাতে পারবে। সে আমাদের বলেছিল সকলের সহযোগিতা পেলে স্কুলটি চালাতে পারবে। আজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বিনামূল্যে শিক্ষাদান করে এলাকার দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সোনিয়া। তার এ প্রতিষ্ঠনটি উন্নত করার জন্য সরকার ও বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা কামনা করি।
এ ব্যাপারে সোনিয়া জানান, আমার ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ছিন্নমূল ও ঝড়েপড়া শিশুদের বিনামূল্যে লেখাপড়া করাবো। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই ২০১৭ সালের শেষদিকে স্কুলের কার্যক্রম শুরু করি। এর মধ্যে আমার সাধ্যমতো তাদের পাঠদান করি। আমার সাথে সহ-শিক্ষক হিসেবে এসআর ইমন, নিজবাহ আক্তার ও শাবনুর সহযোগিতা করছেন। আমার এই স্কুলে অনেকটা কিন্ডার গার্টেনের মতো লেখাপড়া করানো হচ্ছে। এলাকার দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা আমার এখানে পড়তে আসছেন। আমি চাই দরিদ্র পরিবারের কোন ছেলেমেয়ে যেন শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত না হন। বর্তমানে আমার মাহমুদাবাদের স্কুলে ১২০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। এছাড়াও আনোয়ারপুর স্কুলে ৫০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তারা নিয়মিত স্কুলে আসছে। এসব শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব সহকারে ক্লাস নেয়া হয়। আর যখন তাদের পরীক্ষা আসে তখন স্পেশালভাবে ক্লাস করানো হয়। তিনি বলেন, আমি এখন মাস্টার্সের ছাত্রী ও প্রাপ্তবয়স্ক। আমার বয়সের অনেকেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু এই স্কুলটি উন্নত করার জন্য আপাতত আমার মনে বিয়ের কোন পরিকল্পনা নেই। আর যদি কাউকে বিয়ে করি, তিনি আমাকে স্কুলটি পরিচালনা করার দায়িত্ব দিতে হবে। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ স্কুলে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে যান সোনিয়া। এজন্য সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com