তাহমিনা বেগম গিনি
সমস্ত দেয়ালে মেয়েদের, নারীদের, প্রেমিকাদের অতি ছোট বাংলা শব্দে মনের কথা লেখা। যেমন- হে আল্লাহ আমি মাহাবুবকে ভালোবাসি, তুমি তাকে পাইয়ে দাও। আমি আমার স্বামীকে ছাড়া বাঁচবো না, তুমি তাকে কাছে এনে দাও। হে আল্লাহ রহিমকে না পেলে আমি আত্মহত্যা করবো। হে আল্লাহ আমি আর পারছি না, স্বামী শাশুড়ির নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাও। হে আল্লাহ আমি তার (?) সাথে থাকতে চাই নইলে বাঁচবো না।

প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব কিছু ভাললাগা, ভালবাসা, পছন্দ, অপছন্দ থাকে। আমারও তেমনি আছে। মনটা যখন কোনো কারণে- হতে পারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সাংসারিক, পারিপার্শ্বিক কারণে এলোমেলো হয়ে বারবার ছন্দপতন ঘটাতে থাকে, তখন আমি আশ্রয় নিয়ে থাকি আল্লাহর কাছে। পবিত্র কোরআন পড়ে শান্তি খুঁজতে চেষ্টা করি। তারপরও যদি অস্থিরতার আবরণে আবৃত্ত থাকি আল্লাহর নৈকট্যে যতটুকু পারি যেতে চেষ্টা করি। ১৩/১৪টি বছর জীবনের সবচেয়ে মধুরতম সময় কাটিয়েছি সৌদি আরবের তায়েফে। যখনই খারাপ লাগতো সপরিবারে সবাই চলে যেতাম মক্কা- মাত্র এক/দেড় ঘন্টার যাত্রা। হেরেম শরীফে ওমরাহ করে, সবকিছু আল্লাহকে সমর্পণ করে চলে আসতাম। কত কত বার গিয়েছি ওমরাহ করতে-আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতার সীমা নেই এমন সুযোগ আমার মতো নগণ্যকে করে দিয়েছেন বলে। দেশে চলে আসতেই হলো দুই ছেলের পড়ালেখার জন্য। খুব কেঁদেছিলাম মক্কা-মদীনার জন্য। এখনো মিস করি। মাঝে মাঝে বুড়োবুড়ি ওমরাহ করতে যাই, কিন্তু এখন তো নিজে হাঁটতেই পারি না। বলতে গেলে ডা. সাহেব আমাকে হাত ধরেই নিয়ে চলেন। শৈশব, কৈশোরে, যৌবনে বহু দেশ, বিদেশ ঘুরে স্থায়ী আবাস এখন হবিগঞ্জ জেলা। শুনেছি এবং বিশ্বাস করি এ সবই আল্লাহ নির্ধারিত। দুঃখ নেই- হবিগঞ্জকে ভাল লাগে, ভালবাসি। হবিগঞ্জও আমাদের সম্মান ও ভালবাসা দিয়েছে। গোপালগঞ্জের মধুমতি পাড়ের মেয়ে আমি এখন হবিগঞ্জের খোয়াই পাড়ের বাসিন্দা। ২৫/২৬ বছরে খোয়াই নদীটি শ্যামলী থেকে হারিয়ে গিয়েছে। সে দুঃখগাথা থাক। বাবার কর্মজীবনে বড় বড় শহরের অনেক কিছু দেখেছি, সাথে সেই সব এলাকার বড় মাজার শরীফগুলোও। আমি বাংলাদেশে প্রায় বড় সব মাজারেই গিয়েছি প্রথমত: ঐতিহাসিক কারণ, দ্বিতীয়ত: এখানে আল্লাহর প্রিয় একজন বান্দা, ওলি ঘুমিয়ে আছেন। তাকে সালাম জানাতে। ঠিক তেমনিভাবে সিলেটের শাহজালাল (র:) এর মাজার এবং শাহপরান (র:) এর মাজারে বহুবার গিয়েছি। পূণ্যভূমি সিলেট পূণ্যই হয়েছে এই ওলীকুলমনি শাহজালাল (র:) এর সাথে আরো ৩৬০ আউলিয়ার পূণ্য চরণ স্পর্শে। শাহজালাল (র:) এর মাজারের সাথে আমার ছোটবেলা ও আমার মায়ের একটি গভীর বিশ্বাস জড়িত আছে তাই এখনো যখন নানান কারণে মনমানসিকতা অস্থির হয়ে ওঠে, যখন কিছু ভাল লাগে না তখনই ছুটে যাই শাহজালাল (র:) এর মাজার জিয়ারত করে আসি। কয়েকদিন আগে তেমনি গিয়েছিলাম দুই মাজারে। সবাই জানেন শাহজালাল (র:) এর দরগায় মেয়েদের নামাজের জায়গা সিড়ির গোড়ায় স্বল্প পরিসর একটি ঘরে। ওয়াক্তের নামাজের সময় ওখানে স্থান সংকুলান হয় না। শাহপরান (র:) এর মাজারে মহিলাদের নামাজের জায়গা অনেক বড় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: আজ পর্যন্ত কোনদিন ঘরটি খোলা পাইনি। মহিলারা ঘরের বারন্দায় ছেঁড়া অপরিচ্ছন্ন কার্পেটে নামাজ আদায় করেন। আমার মত ব্যাথার রোগীদের জন্য বসার কোনো টুল, চেয়ার, মোড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আজকাল বিশ্বের সমস্ত মসজিদেই এই ব্যবস্থা করা আছে। শাহপরান (র:) এর মাজারে এবার খোঁজ করলাম মহিলা এবাদতখানায় কোনো সুপারভাইজার আছেন কি-না। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এগিয়ে এলেন। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম এত সুন্দর কার্পেট, চেয়ার সম্বলিত এবাদতের রুম থাকতেও আপনি কেন ঘরে তালা লাগিয়ে রাখেন? মহিলা যা বললেন এবং দেখালেন, সেইটুকুনের অবতারণা করার জন্য আজকের এই লেখা। সমস্ত দেয়ালে মেয়েদের, নারীদের, প্রেমিকাদের অতি ছোট বাংলা শব্দে মনের কথা লেখা। লেখার কিছু নমুনা তুলে ধরলাম-
(১) হে আল্লাহ, আমি মাহাবুবকে ভালোবাসি, তুমি তাকে পাইয়ে দাও।
(২) আমি আমার স্বামীকে ছাড়া বাঁচবো না, তুমি তাকে কাছে এনে দাও।
(৩) হে আল্লাহ রহিমকে না পেলে আমি আত্মহত্যা করবো।
(৪) হে আল্লাহ আমি আর পারছি না, স্বামী শাশুড়ির নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাও।
(৫) হে আল্লাহ আমি তার (?) সাথে থাকতে চাই নইলে বাঁচবো না।
বহু বহু আঞ্চলিক ভাষায় লেখায় এমন হাজারো কথা সমস্ত দেয়াল জুড়ে। মহিলার বক্তব্য প্রতিদিন ঘষে ঘষে এগুলো তুলে রঙ লাগাতে হয়। দামী কার্পেটে মলসহ পেম্পার, পিরিয়ডের প্যাড, খাবার দাবার ফেলে রেখে যায়। এমনকি কার্পেটেও রক্ত, মল, খাবার লেগে থাকে। তাই ঘর বন্ধ করে রাখি। ‘‘আসুন আপনাকে খুলে দেই।” আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম হেরেম শরীফ, মসজিদে নববীতে কত ছোট্ট শিশু নিয়ে মায়েরা ইবাদত করেন, এমনতো দেখিনি। আর দেয়ালে লিখে কি হবে? প্রমাণিত হয় আমাদের মেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। সেই প্রেমিক, স্বামী, স্বামীর ঘর, বিদেশ এখনো তাদের মন মানসিকতা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কোথাও কেউ আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে লেখেন নাই “আমাকে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দাও, আমি এই হতে চাই আমাকে সহায়তা করো, আমার মা বাবার জন্য দোয়া চাই, অথবা সন্তানের জন্য”। মনে মনে চাইতে পারেন, আল্লাহর কাছে কাঁদতে পারেন কিন্তু লেখার কি দরকার? আমাদের ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখানো হতো- আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি ইত্যাদি হবো। এখন অনেক মেয়ে শিশুকে এই প্রশ্ন করলে ঝটপট উত্তরই দিতে পারে না। স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই। মা-বাবাকে স্বপ্ন নিয়েই একজন শিশুকে বড় হতে চেষ্টা করা উচিত। আমাদের মেয়েদের এমন মনোবিকার (?) দেখে মনে পড়ে গেলো চারিদিকে এত ধর্ষণ, নির্যাতন, অপহরণ, হত্যার কথা। জাতীয় পত্রিকায় একজন বলেছিলেন, “ধর্ষণ কোনো সংস্থার একার পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয়”। আসলে সঠিক কথাই বলেছেন। শিশুদের মানসিকতা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তাদের চোখে স্বপ্ন আঁকতে হবে, মস্তিষ্কে কোষে প্রতিস্থাপন করতে হবে, “লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমাকে আমার জন্যই কিছু একটা হতে হবে। ভালো মানুষ হতে হবে”। ধর্ষক বা ধর্ষিতা হিসেবে নয়। একবার ধর্ষিতা হয়েছি বলে জীবন শেষ করে দিতে হবে, আত্মহত্যা করতে হবে, যে অন্যায় স্বেচ্ছায় করিনি তার জন্য জীবন কেন ত্যাগ করবো? হ্যাঁ, তবে সাবধান হতে হবে। মোবাইল ব্যবহারে সাবধান হতে হবে। মেয়েরা, নারীরা সাধারণত: মোবাইলের ফাঁদেই পড়েন। পিতামাতা পর্যাপ্ত সময় দিন সন্তানদের। হোক না সে ছেলে কিংবা মেয়ে। ধর্মীয় অনুশাসনের শিক্ষা দিন। আজকাল উভয়ে নির্যাতিত উভয়ে অপরাধি, উভয়েই আমাদের সন্তান। বেগম রোকেয়ার কথা দিয়ে ইতি টানছি “একটি পরিবারের পুত্র ও কন্যার যে প্রকার সমকক্ষতা থাকা উচিত, আমরা তাহাই চাই। যেহেতু পুরুষ সমাজের পুত্র, আমরা সমাজের কন্যা। আমরা ইহা বলি না যে, কুমারের মাথায় যেমন উ্ষ্ণীয় দিয়াছেন, কুমারীর মাথায়ও তাহাই দিবেন। বরং এই বলি কুমারের মস্তক শিরস্থানে সাজাইতে যতœখানি যতœও ব্যয় করা হয়, কুমারীর মাথা ঢাকিবার ওড়না খানা প্রস্তুতের নিমিত্বও ততখানি যতœও ব্যয় করা হউক।”