আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ মনি সাওতাল। বয়স ৫৮ বছর। দেউন্দি চা বাগানের বাদাম টিলায় বসবাস। চা বাগানের গন্ডি পেরিয়ে জীবনে কখনো চুনারুঘাট শহরে আসেননি। কিন্তু গতকাল সোমবার ২২ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে সহকর্মী হত্যার প্রতিবাদ করতে চুনারুঘাট শহরে এসেছেন। তার সাথে হাজারো নারী চা শ্রমিক বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এসেছেন বিচার চাইতে। মনি সাওতালের মতো এসেছেন আরো শত শত চা শ্রমিক নারী। যারা জীবনে চুনারুঘাট শহর দেখেননি, তারাও এসেছেন সহকর্মী হত্যার বিচারের দাবি নিয়ে। মনি সাওতাল জানান, হামদের ভাইকে যারা মারলো, হামরা তাদের ফাঁসি চাই।
মিছিল নিয়ে আসা শত শত নারী বিক্ষোভ মিছিল করছিল আর চারদিকে তাকাচ্ছিল। যেন তাদের মধ্যে ভয় কাজ করছিল। নাম জিজ্ঞাসা করতেই প্রমি সাওতাল ভয় পেয়ে গেলেন। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই বললেন নাম। বললেন আমরা আমাদের ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই, হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই। জীবনে কখনো চুনারুঘাট শহরে আসেননি জানিয়ে বলেন, আজ এসেছি বিচার চাইতে।
সোমবার দুপুর ১টায় চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি, গেলানীয়া ও রঘুনন্দন চা বাগানের কয়েক হাজার নারী পুরুষ চা শ্রমিক বাগানে কাজ বন্ধ রেখে নৈশপ্রহরী অমর তাঁতী হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চুনারুঘাট শহরে আসেন। তারা পুরো শহর প্রদক্ষিণ করে মধ্যবাজার ও উপজেলা গেইটে পথসভা ও মানববন্ধন করেন। এসময় প্রতিবাদ সমাবেশে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির লস্কর তাদের শান্ত করেন এবং এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দেন। এসময় পাইকপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহেদ আলী মাস্টারও উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক সৃপেন পাল, আদিবাসী চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা কাঞ্চন পাত্র, চা শ্রমিক নেতা ভুট্টু বুনার্জী, গেলানিয়া চা বাগান পঞ্চায়েত সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বুনার্জী, গেলানী চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি অমল ভৌমিক, দেউন্দি চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি প্রবীর বুনার্জী, অমৃত তাতী, নৃপেন বুনার্জী, আপন বাকতি, সজল চৌহানসহ বাগানের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। তারা অমর হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার এবং তাদের ফাঁসি দাবি করেন।
গত ১৯ জুন রাতে দেউন্দি চা বাগানে ফাঁড়ি গেলানীয়া চা বাগানের নৈশপ্রহরী অমর তাতী দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনার পর পরই তার সাথে দায়িত্ব পালনকারী অপর দুই নৈশ প্রহরী উপজেলার হলহলিয়া গাজিপুর গ্রামের মৃত এখলাছ মিয়ার পুত্র জামাল মিয়া (৩৫) ও একই গ্রামের মরম আলীর পুত্র কবির মিয়া (৩২) পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে প্রদীপ তাতী বাদী হয়ে চুনারুঘাট থানায় জামাল মিয়া ও কবির মিয়াসহ অজ্ঞাত কয়েক জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এদিকে পুলিশ এ ঘটনা তদন্তে নেমে জানতে পারে নিহত অমরের শ্যালিকা মালতী তাতীর সাথে হলহলিয়া গাজীপুর গ্রামের আব্দুল আউয়ালের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। পুলিশ আউয়াল ও মালতীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে পাঠায়। আউয়াল ও মালতী তাদের প্রেমের কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে। এ ঘটনার জের ধরেই একটি সংঘবদ্ধ দল অমর তাতীকে হত্যা করেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। কিন্তু এ মামলার অপর দুই আসামী জামাল মিয়া ও কবির মিয়া পলাতক রয়েছে।
এর আগে গত ২ জুলাই এ ৩টি বাগানের শ্রমিকরা বাগানে কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে। শ্রমিকরা নিরীহ চা শ্রমিক অমর তাতী হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত খুনীদের দ্রুত গ্রেফতার এবং তাদের ফাঁসি দাবি করেন। এছাড়া হত্যাকান্ডের পর থেকেই চা শ্রমিকরা জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) আলী আশরাফ জানান, পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত আউয়াল ও মালতীকে গ্রেফতার করেছে। বাকী আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
কাজ বন্ধ করে চুনারুঘাট শহরে ৩ বাগানের শ্রমিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com