জান্নাতুল বাকি সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত একটি কবরস্থান। এটি মসজিদে নববীর দক্ষিণ পূর্ব দিকে অবস্থিত। পূর্বে এখানে কবরের উপর স্থাপনা ছিল। পরবর্তীতে সৌদি আরব সরকার তা ধ্বংস করে দেয়। এই কবরস্থানটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
মক্কা মুকাররমা’-এর কবরস্থান হলো, জান্নাতুল মুআল্লা। আর মদিনা মুনাওয়ারা’-এর কবরস্থান হলো-জান্নাতুল বাকি। এর মূল নাম হলো- ‘বাকিউল গারকাদ’। হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় থাকাবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যু হয়।
সাহাবায়ে কেরাম তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, তাকে কোথায় দাফন করা হবে? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে, তাকে ‘বাকিউল গারকাদ’য় দাফন করা হবে। (মুসতাদরাকে হাকিম, খ.১১ পৃ.১৯৩)। এভাবেই এ জায়গা কবরস্থানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়ে যায়। এবং এখানে সর্বপ্রথম (হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দুধভাই) হযরত উসমান ইবনে মযঊন (রা.)-কে দাফন করা হয়।
তারপর কবরস্থান তিনদিকেই প্রশস্ত হতে থাকে। আর আজ তো তা বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববীর পূর্বদিকে অবস্থিত। প্রথমদিকে মদজিদে নববী আর বাকি মাঝখানে ‘হারতুত দাগওয়াত’ নামে একটি মহল্লা আবাদ ছিলো। যেখানে মদজিদে নববীর খাদেমরা তাদের বংশধর নিয়ে বসবাস করতেন। ১৪০৫ হিজরীতে মসজিদে নববী সংস্কারের সময় এই মহল্লাকে অন্য এক জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। এখন এই জায়গা মসজিদে নববীর বারান্দা হিসেবেই ব্যবহার হয়। এবং এটার শেষ প্রান্তেই মসজিদে নববীর চার দেয়াল।
তারপর ‘আবু যর’ নামে একটা সড়ক। তারপর যথেষ্ট উচ্চতার পর জান্নাতুল বাকি। কবরস্থানের চতুর্দিকে একটি উঁচু প্রাচীর। পশ্চিম দিকে একটি বড় গেইট। কবরস্থানে যাওয়ার জন্য একটি প্রশস্ত সিঁড়ি। ফজরের নামাজের পরে এবং আসরের নামাজের পরে কবরস্থান সবার জিয়ারতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাহিরে পুলিশের লোকজন অবস্থান করে।
ভেতরেও শক্তভাবে নজরদারি করা হয়, কোনোপ্রকার বেদাতি কাজ শুরু করলে, তা শক্তহাতে দমন করা হয়। মৃতদের দাফন করার জন্য স্বয়ং আল্লাহপাক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদেশ দিচ্ছেন জান্নাতুল বাকির ফযিলত বোঝার জন্য এতটুকু তথ্যই যথেষ্ট। সর্বপ্রথম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলালাইহি ওয়া সাল্লাম তার দুধ ভাইকে দাফন করেন।
তারপর তাঁর চাচি- হযরত ফাতেমা বিনতে আসাদ (হযরত আলী (রা.)-এর আম্মা) তারপর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ছেলে হযরত ইবরাহিম (রা.)-কে এখানে দাফন করা হয়। তাছাড়াও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র তিন মেয়ে- হযরত রুকাইয়া (রা.), হযরত যয়নাব (রা.) এবং হযরত উম্মে কলসুম (রা.)-কে এখানে দাফন করা হয়।
এই তিন মেয়েই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এর সামান্য সামনে উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) এবং উম্মুল মুমিনিন হযরত মায়মূনা (রা.) ছাড়া বাকি সকল উম্মুল মুমিনিন’র কবর মোবারক। হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) -এর ইন্তেকাল হয় মক্কায়। তাই তাকে জান্নাতুল মুআল্লায় দাফন করা হয়। উম্মুল মুমিনিন হযরত মায়মূনা (রা.)-এর ইন্তেকাল মক্কা থেকে ১০ মাইল দূরে “মাকামে সরফে’ হয়। সারাফ মদিনা দিকে আসতে যে সড়ক পাওয়া যায়, এর পাশেই।
এটা আশ্চর্যজনক যে, হযরত মায়মূনা (রা.)-এর বিবাহও এই জায়গায় হয়। এবং মৃত্যুও এই জায়গায়। এবং এখানেই তার মাকবারা। উম্মাহাতুল মুমিনিন’র মধ্য থেকে শুধু উম্মুল মুমিনিন হযরত যয়নাব বিনিতে খুযাইমা রা.-এর মৃত্যু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’এর জীবদ্দশায় ঘটে। এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তাকে দাফন করেন। বাকি উম্মাহাতুল মুমিনিনরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র বিদায়ের পর মৃত্যুবরণ করেন। এবং তাদের সকলকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়।
যদি সামান্য বামদিকে যান, তাহলে ছোট একটি অংশ নজরে আসবে, এখানে হযরত আলী (রা.)-এর ভাই হযরত আকিল এবং তার ভাতিজা আবদুল্লাহ ইবনে জাফর তৈয়্যার (রা.)’ এর কবর। এর বরাবর একটি শারী। এবং শুরুতেই হযরত নাফে রা. এবং হযরত ইমাম মালিক রহ.-এর কবর। এর সোজা বরাবর সামনে বেড়ে আরো কিছু কদম পরে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সাহেবজাদা হযরত ইবরাহিম (রা.) এর কবর। এর কিছুটা দূরে হযরত ওসমান (রা.)-এর কবর। এবং এর বিপরীত দিকে হযরত হালিমা সা’দিয়া (রা.) এর কবর। এর মধ্যখানে আরেকটি বেড়া রয়েছে যে পাশটায় শুহাদাদের দাফন করা হয়েছে। দরজা দিয়ে প্রবেশ করে ডান দিকে দেয়ালের বিলকুল নিচে ইসমাঈল ইবনে জাফরের মাজার। বামদিকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র ফুফুর কবর। এই পুরো কবরস্থানেই বড় বড় হাস্তিদের কবর মোবারক। এখন আর সেখানে দাফন হয় না।
হ্যা অবশ্যই সৌদি সরকার এখন এটাকে উত্তর-পশ্চিম দিকে যথেষ্ট প্রশস্ত করছে। এখানে সাধারণ সব মুসলমানদের দাফন করা হয়। এর বেশিরভাগই হাজি। মূলত তারাই তো সৌভাগ্যবান, যারা মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। সৌদি সরকার দু’বার বাকিকে সংস্কার করেছে। প্রথম সংস্কার করে শাহ ফয়সাল ইবনে আবদুল আজিজের আমলে।
এসময় ‘বাকিউল গামাত’ এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত একটি সড়ককে বাকির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। উত্তর দিক থেকেও এক অংশকে বাকির সঙ্গে প্রশস্ততায় যুক্ত করা হয়। সর্বমোট ছয় হাজার মিটার সংযোগ করা হয়। তাছাড়া বাকির ভেতরে পাকা রাস্তা বানানো হয়। যাতে করে বৃষ্টির মৌসুমে দর্শনার্থী এবং দাফন করতে আসা লোকদের কোনধরনের কষ্ট না হয়।
দ্বিতীয় দফা সংস্কার হয়, শাহ ফাহাদ’র আমলে। এবং সময় আশপাশের সকল মহল্লা, বাজার, সড়ক উচ্ছেদ করে জান্নাতুল বাকিতে সংযুক্ত করে জান্নাতুল বাকিকে প্রশস্ত করা হয়। এখন জান্নাতুল বাকির চতুর্দিকে সতেরশো চব্বিশ মিটার লম্বা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। এবং এতে মরমর পাথর লাগানো হয়েছে। এবং দেয়ালে কালো রঙের লোহার জালি লাগানো হয়েছে। জান্নাতুল বাকির একপাশে মৃতের গোসল দেয়া এবং কাফন পরানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জান্নাতুল বাকি’র ফযিলত সম্পর্কীয় হাদিস অনেক। এই কবরস্থানের সবচেয়ে বড় ফযিলত হলো- হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাত্রিবেলা ঘুম থেকে উঠে এখানে চলে আসতেন এবং এই কবরস্থান’য় শায়িত লোকদের মাগফিরাত’র জন্য দোআ করতেন। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত লম্বা একটি হাদিসে একটি ঘটনা হলো-
‘একদিন রাসুল (সা.) (বণ্টনানুযায়ী আমার নির্ধারিত দিনে) পাশে ছিলেন। কিছুক্ষণ থাকার পর যখন দেখলেন আমার চোখের পাতা বুজে গেছে। তিনি আস্তে আস্তে উঠলেন এবং সাবধানতার সঙ্গে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেলেন। তারপর আবার শান্তশিষ্টভাবে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি উঠে কাপড় পরিবর্তন করলাম। এবং চাদর গায়ে দিয়ে তার পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম। তিনি জান্নাতুল বাকিতে প্রবেশ করে একটি জায়গায় দাঁড়ালেন। প্রায় অনেকক্ষণ যাবত তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই থাকলেন।
তিনবার হাত উঠিয়ে দু’আ করলেন। তারপর মুখ ঘুরালেন। আমিও মুখ ফিরালাম এবং খুব দ্রুত গতিতে বরং বলা যায়, দৌঁড়ে দৌঁড়ে এসে ঘরে প্রবেশ করলাম। তারপর ঠিকঠাকভাবে আগের মতো আস্তে করে শুয়ে পড়লাম। আমি ঘরে পৌঁছুতে না পৌঁছতে দেখি, তিনিও ঘরে পৌঁছে গেছেন। এসে বলতে লাগলেন, আয়েশা! তোমার কি হলো?
তোমার শ্বাস যে ফুপে উঠছে। বললাম, না কিছুই না। বললেন, নিজে বলে দাও, নয়তো আমার সুক্ষ্ম সংবাদদাতা (আল্লাহ) আমায় সব বলে দেবেন। বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর উৎসর্গ হোক! ঘটনা হলো, এই…। বললেন, আচ্ছা! ওই ছাঁয়া তাহলে তোমার ছিলো? যেটা আমি ওখানে দেখছিলাম। বললাম, জি হ্যা! বললেন, তোমার সংশয় ছিলো, আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার উপর জুলুম করবেন। বললাম, লোক যতোই লুকোচুরি করুক না ক্যান। আল্লাহ তো জেনেই ফেলেন।
তারপর তিনি আমাকে বললেন, কথা হলো, হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আমার কাছে আসছিলেন। তিনি আমাকে আস্তে আস্তে ডাকছিলেন, যাতে তুমি বুঝতে না পারো। তিনি ভেতরে আসতে পারছিলেন না, কেননা, তখন তোমার কাপড় এলোমেলো ছিলো। আমিও ভাবলাম তুমি শুয়ে আছো। এজন্য আমি তোমাকে আর জাগানোও সমীচীন মনে করিনি।
আমার এটাও ভয় ছিলো, তুমি একা এখানে ভয় পাবে। জিবরাইল আলাইহিস সালাম, আমাকে বলতে লাগলেন, আপনার রব আপনাকে হুকুম করছেন, আপনি (জান্নাতুল) বাকিবাসীদের কাছে যাবেন। এবং তাদের জন্য মাগফিরাত’র দু’আ করবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৯৭৩)
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার বণ্টিত নির্ধারিত দিন আমার কাছে থাকাবস্থায় রাতের প্রায় শেষাংশে উঠে বাকিতে চলে যেতেন। এবং বলতেন-
‘হে মুমিন শহরবাসীরা! তোমাদের ওপর সালাম বর্ষিত হোক। কালই তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুত বস্তু পাচ্ছো। তোমরা (কিয়ামতের জন্য) বিলম্ব করছ। ইনশাআল্লাহ! আমরাও অচিরেই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি। হে আল্লাহ! বাকিবাসীকে মাফ করে দাও।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির জমিন চিড় ধরবে, সে ব্যক্তি আমি। তারপর আবু বকর (রা.), তারপর ওমর (রা.), তারপর আহলে বাকি। আমি আহলে বাকি’র পাশে আসবো। তারা আমার সঙ্গে একত্র হবে। তারপর আমি মক্কাবাসীর অপেক্ষা করবো। তারা মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি জায়গায় এসে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। (সুনানে তিরিমিযি, হাদিস নং-৩৬২৫; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস নং-৩৬৯১)
হযরত উম্মে কায়েস বিনতে মুহসিন হতে বর্ণিত, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ কিয়ামতের দিন সত্তরহাজার লোক কবর থেকে এমনভাবে উঠবে যে, তাদের চেহারা চতুর্দশ রাত্রির পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় চমকাতে থাকবে। এবং এই সকল লোক কোনো হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস নং-৭০৩৫)
লেখক : নাজমুল ইসলাম কাসিমী