ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
চাচা সিদ্ধান্ত নিলেন এবার বোঝাই নৌকা নিয়ে ধানের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র মদনগঞ্জ যাবেন। আমিও খুশি হলাম এই ভেবে যে শীতলক্ষ্যার একপাড়ে কুমিল্লার মদনগঞ্জ আর অপর পাড়ে ঢাকার নারায়ণগঞ্জ। পঞ্চম শ্রেণী থেকেই পাঠ্যবই ভূগোলের সুবাদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রসিদ্ধ নদ-নদী, শহর-বন্দর সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা ছিল। অতএব পাটের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র ‘প্রাচ্যের ডান্ডি’ নারায়ণগঞ্জ ইচ্ছমত ঘুরে দেখতে পারব। আমার এ পুলকিত মনোভাব চাচা আঁচ করতে পেরেছিলেন।
আমার বাবার চেয়েও এ চাচার সাথে সম্পর্কটা ছিল অনেক মধুর। কোন আবদার বাবার নিকট রাখতে ভয় বা সংকোচ করলেও চাচা ছিলেন ভরসার স্থল। একান্নবর্তী পরিবারে আমিই ছিলাম নতুন প্রজন্মের প্রথম এবং প্রধান অতিথি। দ্বিতীয়ত প্রাইমারী স্কুল জীবনে একজন ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিতিটাও পারিবারিক, সামাজিক আদরের মাত্রাটাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতেও কলেজ এবং মেডিকেল জীবনে হোস্টেলে থাকাকালীন এ চাচার নিকটই টাকার প্রয়োজনে চিঠি লিখতাম। কারণ ছিল আমি যা চাইতাম চাচা তা ই পাঠাতেন। বরং বাবা একটু এদিক সেদিক করতেন, হয়তবা দায়িত্বটুকু উনার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে। তাই অনেক না বলা কথা বা চাহিদাটুকুও এ চাচা কেনজানি সহজেই বুঝতে পারতেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর চাচা নৌকার পিছনের পাটাতনে বিছানা করে দিলেন। কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
যখন ঘুম ভাংল তখন বিকেল প্রায় চারটে। আমাদের অনুকূলে মৃদু বাতাসে নৌকায় পাল তুলে সবাই ছই এর উপরে পালের ছায়ায় বসে আড্ডা দিচ্ছেন। একটার উপরে আর একটা এভাবে মাস্তুলে পর পর তিনটা পাল। সবকটা বাতাসে সামনদিকে ফুলে আছে। নিচ থেকে উপরের দিকে পালগুলো ক্রমান্বয়ে বড় থেকে ছোট। কম বাতাসে তিনটা, মাঝারি বাতাসে দু’টা এবং বেশি বাতাসে একটা পাল টানা হয়।
নৌকায় পাল তোলার পদ্ধতিটা কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। প্রথমে বড় মাস্তুল খাড়া করা হয়। পাল দু’টা বা তিনটা উঠাতে হলে বড় মাস্তুলের ডগায় ছোট মাস্তুলগুলো জোড়া দিতে হয়। মাস্তুল খাড়া হলে অনেকগুলো রশি ঝুলে থাকে। তখন মনে হয় এ যেন সিন্দাবাদের এক ছোট জাহাজ। নৌকার আগা পাছায় বাথার (কিনারার উপরের দিকের মোটা অংশ) কড়াইয়ার সাথে টানা দিয়ে পরে যে মোটা রশি ধরে পাল উঠানো হয় এগুলোকে ‘এশা’ বলে। গড়গড় শব্দে কড়ার ভিতর দিয়ে হেইও টানে যখন পাল তোলা হয় এ এক অপরূপ দৃশ্য! পাল উঠানোর রশি অর্থাৎ এশাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নৌকায় কোন সময় ডাকাত পড়লে প্রথমেই উঠে কাঁচি দিয়ে এশাটাকে কেটে ফেলে। তৎক্ষনাৎ পাল পড়ে গেলে নির্দিষ্ট স্থানে নৌকা আটকিয়ে ওরা ডাকাতি করে। তাই হাওর বা বিশেষ জায়গাগুলোতে এশা পাহাড়া দেয়ার জন্য দু’একজনকে এশার পাশে বসে থাকতে হয়।
তখন মোবাইল ছিল না, তাছাড়া আমার মত মধ্যবিত্ত এক কিশোরের হাতে ক্যামেরা? প্রশ্নই উঠে না, হাতের সাদামাটা ঘড়িটাই ছিল সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আর সম্পত্তির মর্মার্থ বা পোকা তখনো মাথায় ঢোকেনি। তাই ছবি তোলে রাখার কোন সুযোগ ছিল না। তবে সুন্দর দৃশ্যাবলী যতটুকুই আজো স্মৃতিতে জাগরূক তা হল সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত লক্ষ কোটি জি বি (গিগাবাইট) সমৃদ্ধ মস্তিষ্কের ফলিত (অরগানিক) মেমোরি কার্ডে সংরক্ষিত থাকার কারণে। আমাদের আগে পিছে নানা রঙের পাল উড়িয়ে চলা আরো অনেক নৌকা। আমিও বই হাতে নিয়ে উপরে উঠে গেলাম। দরছ ভাই বিভিন্ন গ্রাম, লঞ্চ স্টেশনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আর আমি মানচিত্রের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। কখনো কখনো তাদের ভুল ধরিয়ে দিচ্ছিলাম।
দু’দিন যাবৎ ডাঙ্গার সাথে কোন সংস্পর্শ নেই, নৌকার গলুইয়ে পা রাখার পর জলের উপরেই চলছে বসবাস। তারপরও খারাপ লাগেনি মোটেও। এ ধরণের সুযোগ জীবনে সাধারণত বার বার আসে না। কারণ ‘জধৎব ঃযরহমং ধৎব ধষধিুং ৎধৎব’. দ্বিতীয়ত বিচিত্র বাংলাদেশের এমন বৈচিত্রময় দৃশ্যাবলী, ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে নদীমাতৃকার নান্দনিক রূপ পরিবর্তন বিশ্বের আর কোথাও নেই। নিজ চোখে এ বয়সে এসব অবলোকন করার সৌভাগ্য ক’জনারই বা আছে। হঠাৎ নজরে পড়ল উল্টোদিক থেকে আসা ফুলে ফুলে সাজানো একটা বিয়ের পানসি নৌকা। মাইকে আব্দুল আলীমের ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী…, আমারে সাজাইয়া দিও…’ এমনিতর অনেক গান। ভাসমান পানিতে চলন্ত নৌকার গানের তরঙ্গ এ যে অন্যরকম এক অনুভূতি! পড়ন্তবেলায় ধীরে ধীরে দূরে হারিয়ে যাওয়া পানির উপর দিয়ে ভেসে আসা গানের ঐ হৃদয় স্পর্শ করা সুর আর আজ বহমান জীবনের শেষ বিকেলে ফেলে আসা নস্টালজিক অস্পষ্ট স্মৃতিগুলোর করুণ রোমন্থন মনে হচ্ছে যেন একই সমতলে, একই সুতোয় বাঁধা। যেন দূর দিগন্তে ফেলে আসা ম্রিয়মান আবছা কোন গাঁয়ের ছবি। যেন ‘সে হারাল কোথায় কোন দূর অজানায়’। এসবইত ‘বেলা শেষের গান’।
চলবে…..