মনসুর আহমেদ ॥ সুতাং নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়ে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লাখাই উপজেলার মাদনা এলাকা হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনার শাখা কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিদের নজরদারির অভাবে বহমান এ নদীটি কালের আবর্তে বিলীন হতে চলেছে। পাহাড়ি ঢল ও অতি বর্ষণের ফলে ভারত থেকে আসা উজানের পানি ও পলি মাটিতে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে নদীটি। দীর্ঘদিন ড্রেজিং না করায় ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য এ নদীটিকে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত করেছে। এর প্রধান কারণ কোম্পানিগুলোতে নিয়মিত ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) ব্যবহার না করা। যেসব কোম্পানিতে ইটিপি রয়েছে, সেগুলো অতিরিক্ত খরচের ভয়ে নিয়মিত চালানো হচ্ছে না। সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেখাতে অনেক কোম্পানি ইটিপি স্থাপন করেছে। কিন্তু এগুলো বন্ধ রেখে কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সুতাং নদীতে। অথচ শিল্প-কারখানায় ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। রহস্যজনক কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। ফলে নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার নুরপুর, রাজিউড়া, ফান্দ্রাইল, সানাবই, উচাইল, বেকিটেকা, নাজিরপুর, লুকড়া, লাখাই উপজেলার করাব, বুল্লা, বেগুনাই, বরগান্দিসহ বেশ কটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামগুলোতে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক বিপর্যয়ের পাশাপাশি উদ্বেগজনক মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে সুতাং নদীর পানি কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সুতাং নদীর পানি দূষণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকায় রয়েছে প্রাণ (আরএফএল) ও স্কয়ার কোম্পানির একাধিক প্রতিষ্ঠান। তারা অলিপুর এলাকায় বিশাল আয়তন নিয়ে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সুতাং নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিষাক্ত বর্জ্যের মারাত্মক দূষণে পানি বিষাক্ত হয়ে মরে যাচ্ছে নদীর মাছ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় জেলেরা। অন্যদিকে চাষাবাদে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল।
আদিকাল থেকেই হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলাকে শস্য ও মৎস্য ভান্ডার বলা হয়ে থাকে। উপজেলার খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে হবিগঞ্জ জেলাসহ সারা দেশে খাদ্যের চাহিদা পূরণে সহায়তা করে আসছে লাখাইয়ে উৎপাদিত খাদ্যশস্য। কিন্তু সে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। পানি সংকটের কারণে লাখাইর বিস্তীর্ণ এলাকার ইরি বোরো ধানি জমি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এক সময়ের খরস্রোতা সুতাং নদী বর্তমানে মরা খালে পরিণত হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই সুতাং নদী তার জৌলুস হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত খনন না করায় নদীটি শুকিয়ে গেছে। সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে লাখাই উপজেলার প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এছাড়া হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এর বেশির ভাগই সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে। নদীর পানির অভাবে প্রতিবছর চাষাবাদ করতে কৃষকদের হিমশিম খেতে হয়। এতে প্রতি বছর-ই ব্যাহত হচ্ছে বোরো উৎপাদন।
লাখাই উপজেলার করাবের কৃষক আমির হামজা জানান, শিল্পবর্জ্যে নদীর তলদেশ ভরাটের পাশাপাশি তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কৃষি কাজের জন্য নদীর পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পানির অভাবে এলাকার ইরি বোরো ধানি জমি চাষাবাদ করতে না পারায় আমাদের খাদ্য সংকটে ভুগতে হবে। বুল্লা গ্রামের কৃষক সায়েদ আলী বলেন, নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত জেলেরা। কালো কুচকুচে পানিতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। ফলে শত শত জেলে বেকার হয়ে পড়েছে।
হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম বলেন, “আমি দীর্ঘদিন ধরে সুতাং নদীর দূষণ নিয়ে আন্দোলন করে আসছি। গত উপজেলা নির্বাচনের পর পর-ই জেলার পরিবেশ কর্মীদের নিয়ে সভা সমাবেশ করে আমরা সরেজমিনে সুতাং নদীর আশেপাশে গড়ে ওঠা কল কারখানা পরিদর্শন করি এবং নদীর দূষণ দেখে কোম্পানিগুলোর কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) ব্যবহার করতে অনুরোধ করেছি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে শোনেনি তারা এখনো সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অচিরেই আমরা প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”
সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর জাতীয় পরিষদের আজীবন সদস্য ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, “সুতাং একটি আন্তঃদেশীয় নদী। আজ থেকে দু’দশক পূর্বেও এ নদীটি দূষণমুক্ত ছিল। এ নদীর দু’পারের জনপদের কৃষি ও দৈনিন্দিন কাজে পানির অন্যতম উৎস ছিল সুতাং নদী। দেশী মাছের অন্যতম আধারও ছিল এ নদী। হবিগঞ্জে গড়ে ওঠা অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ইটিপি ব্যবহার না করে শিল্পবর্জ্য সরাসরি পার্শ্ববর্তী খালে ফেলে দিচ্ছে। যা পড়ছে সুতাং নদীতে। পরবর্তীতে সুতাং নদীর মাধ্যমে হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর ও মেঘনা আববাহিকা হয়ে দেশের সার্বিক নদীব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সরকার যদি কঠোর না হয় কেবল পরিবেশবাদীরা সভা-সেমিনার করে এ থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। হবিগঞ্জে শিল্পায়নের নামে যা হচ্ছে তা দেশের শিল্পনীতি, পরিবেশ নীতি তথা সার্বিকভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।”
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, “গ্যাস এবং কৃষি জমির সহজলভ্যতার জন্য এই অঞ্চলের বৃহৎ এবং মাঝারি আকারের অনেক কলকারখানা গড়ে উঠেছে। জেলার বিশাল এলাকা নিয়ে কল কারখানা গড়ে উঠলেও কার্যত এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। কলকারখানার মাধ্যমে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বর্ষা মৌসুমে হাওর অঞ্চলে জলজ প্রাণী দেশি মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। সুতাং নদীসহ অন্যান্য খাল-বিলে নিক্ষিপ্ত বর্জ্য নদী এবং খালের তলদেশে স্তর পড়ে গেছে। অসহনীয় দুর্গন্ধ এবং দূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে গেছে বহুগুণ। প্রাণ-প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। কলকারখানাগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাসহ পরিবেশ গত বিষয়গুলো দেখবালের জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান দরকার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান থাকলেও হবিগঞ্জে সেটি নেই। গুরুত্ব অনুধাবন করে হবিগঞ্জে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। নীতি নির্ধারকরা এই ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করবেন বলে আশা রাখি।”
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com