এম এ মজিদ
আপনার আমার পরিচিত কতজনের নাম স্মরণে থাকতে পারে, ২শ ৩শ কিংবা ৫শ! আপনি হিসাব করে মিলিয়ে দেখবেন এর বেশি দূর আমরা যেতে পারব না। কিন্তু আল্লামা তাফাজ্জুল হক, এ ক্ষেত্রে এক বিরল যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিছু সময় তাঁর সাথে যাদের বসা, আলোচনা করার সুযোগ হয়েছে তারা বিনা বাক্যে স্বীকার করবেন হাজার হাজার মানুষের নাম, গ্রামের নাম, বর্তমান অবস্থা ছিল তাঁর মুখস্থ। আমরা যারা সংবাদপত্রের সাথে জড়িত তারা হয়তো অনেকেই জানি না, আল্লামা তাফাজ্জুল হক নবীন প্রবীন মিলিয়ে পুরো জেলার অন্তত অর্ধশত সংবাদকর্মীর নাম বলতে পারতেন। অনেকের শ্বশুর বাড়ির অবস্থা পর্যন্ত জানতেন। বেশির ভাগ সংবাদকর্মীর বাবার নাম ও গ্রামের নাম জানতেন। সবাইকে তিনি নাম ধরে ধরেই ডাকতেন। দেখা হলেই কথা হলেই জানতে চাইতেন, ফজলু (সাংবাদিক ফজলুর রহমান) কি করে, খোয়াইর হারুনের (হারুনুর রশিদ চৌধুরী) পত্রিকা কেমন চলছে, নাহিজের (মোহাম্মদ নাহিজ) তো প্রশাসনের সাথে ভাল সম্পর্ক, প্রতিদিনের বাণীর মোহাম্মদ শাবান মিয়া, সমাচারের গোলাম মোস্তফা রফিক, আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক সেলিম আজাদসহ প্রায় প্রত্যেকের কথা বলতেন, তাদের অবস্থা জানতে চাইতেন। কাউকে খুশি বা অখুশি করার জন্য না, মৃত এই আলেমে দ্বীন সম্পর্কে এক দন্ড বানিয়ে বানিয়ে বলারও আমার কোনো ইচ্ছা নাই। কিছুদিন আগে দীর্ঘ ১ মাস অসুস্থতা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে ২য় জুমার নামাজের খুৎবায় তিনি হেসে হেসে বলছিলেন আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ, ডাক্তাররা এখন আমার সাথে হাত মেলানোর অনুমতি দিয়েছেন। এর আগের জুমায় ডাক্তারদের নিষেধ থাকায় ওনাকে শুধু দেখেছি, কথা বলতে পারিনি, হাত মেলাতে পারিনি। কোনো দিন তাফাজ্জুল হক সাহেবের সাথে একটা ছবি তোলার আমার সাহস হয়নি। নামাজের পর মুসল্লীরা লাইন ধরে আল্লামা তাফাজ্জুল হক সাহেবের সাথে হাত মেলাতে লাগলেন। বরাবরের মতোই আমি অনেক পরে ওনার সাথে হাত মিলিয়েছি। উদ্দেশ্য কিছু কথা বলা, সময় নেয়া। আমার এখনও মনে আছে, দীর্ঘ সময় তিনি আমার হাত ধরে রাখলেন, ইতিপূর্বে এতো দীর্ঘ সময় তিনি কখনও আমার হাত এভাবে ধরে রাখেননি। কেমন আছি জানতে চাইলেন, গ্রামে ঝগড়াঝাটি (আমাদের গ্রামে বেশ কিছুদিন যাবত দাঙ্গা হয়ে আসছিল, খুনও হয়েছে, বাড়িঘর পুড়ানোর ঘটনাও ঘটেছে) নিয়ন্ত্রণে আসছে কি না জানতে চাইলেন। প্রায় এক মাস আগে জুমার খুৎবায় তিনি মহিলাদের পৃথক মাহফিলের জন্য হাদিয়া তুলছিলেন। আমি এর আগের জুমায় কিছু হাদিয়া দিয়েছি। পরের জুমায় আবারও তিনি হাদিয়া দিতে মুসল্লীদের উৎসাহ দিলেন। আমি আমার সামনের একজন মুসল্লীর মাধ্যমে অনেকটা লুকিয়ে হাদিয়া দিলাম। তাফাজ্জুল হক সাহেবের নজর এড়াতে পারলাম না। মুসল্লীদের জানিয়ে দিলেন সাংবাদিক ও অ্যাডভোকেটের নোটটা তো অনেক বড়। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। আমাকে কোনো সময় সাংবাদিক, কোনো সময় অ্যাডভোকেট, কোনো সময় পুরো নাম ধরেই ডাকতেন। আমি প্রতি জুমার খুৎবা পরের দিনের পত্রিকায় প্রেরণ করতাম। হবিগঞ্জের পত্রিকাগুলো গুরুত্ব সহকারে ছাপাতো। তিনি অনেক সময় জুমার খুৎবায় বলে দিতেন, লন্ডন আমেরিকা কানাডা থেকে মানুষ আমাকে ফোন করে, আমি জুমার খুৎবায় কি বলেছি তা তারা পড়েছে। কোনো এক জুমার খুৎবার বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক। আমি তাফাজ্জুল হক সাহেবের কথার থিম পরিবর্তন করিনি। তবে কিছু অলংকারিক রূপ দিয়েছিলাম। পরের দিন দেখা হতেই বলে দিলেন, সাংবাদিক, আমার বক্তব্যকে অতিরঞ্জিত, আকর্ষণীয় করে দিও না। যা বলি, তাই দিও। আমি লজ্জিত হলাম। আমি গত ৩০ ঘন্টায় অন্তত ৫০ জনের সাথে কথা বলেছি। বিশ্বাস করুন কমপক্ষে ৪০ জনই বলেছেন তাদের সাথে তাফাজ্জুল হক সাহেবের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা। আমার জানামতে তাফাজ্জুল হক সাহেবের দাওরায়ে হাদিস বিভাগের পূর্বাপর প্রায় প্রত্যেক ছাত্রের নাম মুখস্থ, তাদের বাড়ির ঠিকানা মুখস্থ ছিল। প্রায় আড়াইশ মাদ্রাসা ছাত্রী যারা হাদিস শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে বের হয়েছেন, তাদের বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানা অনর্গল বলে দিতে পারতেন তিনি। মানুষের নাম স্মরণ রাখা সহজ কোনো বিষয় নয়। কারণ একটা মানুষের সাথে আপনার প্রতিদিন দেখা হয় না। আপনার স্মৃতিতে প্রতিদিন কোনো না কোনো মানুষ যুক্ত হচ্ছে, কোনো না কোনো মানুষ স্মৃতি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বেশির ভাগ সময় উপ-মহাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, এদেশে ইসলাম প্রবেশের কাহিনী বর্ণনা করতেন। অনেকে মনে করতে পারেন, মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা ইসলাম ছাড়া কিছু বুঝে না, ইতিহাস ঐতিহ্য তাদের বিষয় না। আল্লামা তাফাজ্জুল হককে আমি একজন জীবন্ত ইতিহাসবিদ মনে করতাম। সমসাময়িক জ্ঞান ছিল ঈর্ষনীয়। বিশ্ব রাজনীতির এক পন্ডিত ছিলেন তিনি। হাজার হাজার মুহাদ্দিসের ওস্তাদ আল্লামা তাফাজ্জুল হক সাহেবের শেষ দিনটিও কেটেছে হাদিস শাস্ত্র পড়িয়ে। আমি তেতৈয়া মাদানীনগর মহিলা মাদ্রাসার ছাত্রীদেরকে অধিক সৌভাগ্যবান মনে করি এ জন্য যে, তারা আল্লামা তাফাজ্জুল হক সাহেবের মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগেও তার কাছ থেকে হাদিস শাস্ত্র পড়েছে। জমিয়তে উলামার নেতৃবৃন্দও ধন্য যে, তাফাজ্জুল হক সাহেবের মৃত্যুর মাত্র ৩/৪ ঘন্টা আগেও তারা তার সর্বশেষ নসিহত শুনতে পেরেছে। শিব্বির আহমেদ ছিলেন যোগ্য খাদেম। জানাজার নামাজে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম প্রমাণ করে আল্লামা তাফাজ্জুল হক সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে। মনটা ভরে গিয়েছিল যখন দেখেছি তাফাজ্জুল হক সাহেবের লাশ ধৌত করার আগ থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন চৌধুরী বাজার জামে মসজিদের ইমাম আল্লামা মুফতি আব্দুল মজিদ। আমি একটা জিনিসের হিসাব মেলাতে পারি না, তাফাজ্জুল হক সাহেবের মৃত্যুর সংবাদটি কেন হবিগঞ্জ শহরের প্রত্যেকটি মসজিদের মাইকে এলান করা হয়নি। শায়েস্তানগর জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন নুর মোহাম্মদের মৃত্যুর সংবাদটি হবিগঞ্জ শহরের প্রত্যেকটি মসজিদের মাইকে যখন এলান করা হয়েছিল তখন খুব ভাল কিছু অনুভব করেছিলাম। একজন আলেমে দ্বীনের মৃত্যুর সংবাদটি মসজিদগুলোর মাইকে এলান না করা হয় অজ্ঞতা, নয়তো সংকীর্ণতার বহিপ্রকাশ। মসজিদের মাইকগুলোয় মৃত্যুর সংবাদটি জানিয়ে দিলে পাড়ায় পাড়ায় অন্য ধরনের ভাব গাম্বীর্যের সৃষ্টি হতো। এটা একটা ব্যর্থতা। এর দায়ভার কাউকে না কাউকে নিতেই হবে।
লেখকঃ আইনজীবী ও সংবাদকর্মী
হবিগঞ্জ ৬ জানুয়ারি ২০২০
০১৭১১-৭৮২২৩২